হাতি খেদিয়ে বেলবনির ভরসা আটপৌরে ‘রানি’
সোনামনির ‘বে’টা শেষ-তক নির্বিঘ্নেই মিটে গিয়েছিল।
সে বিয়েতে হাতি নাচেনি, ঘোড়াও না। চাঁদ একটা উঠেছিল বটে তবে, সেই জ্যোৎস্নায় চরাচরের ছবিটা ছিল ঈষৎ ভিন্ন প্রাণ ভয়ে ছুটছে দীঘল এক ঐরাবত। আর, তার পিছনে রাঙা ধুলো উড়িয়ে তাড়া করছে মেটে রঙের আটপৌরে এক দিশি ঘোড়া, রানি।
পড়ন্ত হ্যাজাকের আলোয় ছাদনাতলায় জড়োসড়ো বরযাত্রীকুল সেই চাঁদনি-সন্ধ্যায় জুলুজুলু চোখে দেখেছিলেন, অবাস্তব সেই হস্তি-বিতাড়ন দৃশ্য!
সোনামনির বিয়ের সেই রাতে বাঁকুড়ার পিড়রাগোরা গ্রাম এ ভাবেই চিনেছিল নিতান্তই ছা-পোষা রানিকে। তার বৈভবের সূত্রপাত এ ভাবেই।
মাঘ মাসের সেই সাঁঝের পর থেকে রানির কদর-আদর দুই বেড়ে গিয়েছে। অনিল মণ্ডলের ইটভাটায় খড়ের ছাউনির নীচে তার নির্বিকার জাবর কাটা দেখতেও এখন ভিড় করে ছেলেপুলেরা। ফিসফিস করে বলে, “বেশি কাছে যাস না কিন্তু!” কিঞ্চিৎ দূরে দাঁড়িয়ে গ্রামের মুরুব্বিরাও সসম্ভ্রমে বিড় বিড় করেন, ‘গাঁয়ের গর্ব, কী বল!’ আর, দুপুরে গ্রামের পুকুরে স্নান সেরে ভেজা কাপড়ে ভিটেয় ফেরার আগে পিড়রাগোরার মহিলারাও রানির অলস ঝিমুনির মধ্যে খুঁজে পান, ‘কী দাপট!’
অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
কী সেই দাপট? তা হলে বছর দুয়েক পিছনে ফিরে যেতে হবে।
শীতের এক সন্ধেয় পিড়রাগোরা গ্রামের সোনামনি মণ্ডলের বিয়ে। গরুর গাড়ি চেপে বরযাত্রী আর গ্রামের উত্তাল খোয়াই ডিঙিয়ে বর এসেছে মোটরবাইকে। জঙ্গলের কোলে গ্রাম। তাই সাত তাড়াতাড়ি লগ্ন দেখে মিটে গিয়েছে মালাবদল। বিয়ে মিটল। কিন্তু শুরু হল অন্য বিড়ম্বনা। নিমন্ত্রিতের তালিকায় না থাকলে কী হবে, আচমকা বেলবনির জঙ্গল ফুঁড়ে হাজির হল এক হাতি।
বাঁকুড়ার জঙ্গলে দলমার দামালদের মরসুমি যাতায়াত নতুন নয়। কিন্তু সে শীতে বেলবনির ত্রাস ছিল এক মালজুরিয়ান রেসিডেন্ট (দল-ছুট দন্তহীন দুষ্টুমতি হাতি)। বনকর্তারা বলছেন, “বহু চেষ্টাতেও তাকে কব্জা করা যাচ্ছিল না। রাতে তো বটেই, দিনে-দুপুরেও গ্রামে হানা দিয়ে ঘরবাড়ি লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যাচ্ছিল সে।” জনা তিনেক গ্রামবাসী খুনে মূল অভিযুক্ত সেই হস্তি আগমনে ত্রাহি রব পড়ল গ্রামে। আর, তাকে দেখে চিঁহি-ই-ই চিৎকারে খুর ঠুকল রানি। স্থানীয় আয়না গ্রামের আশিস বাউল বলছেন, “রানির রাগারাগি দেখে হাতি এগিয়ে এল। তার পর শুঁড়ে পাকিয়ে তাকে ছুঁড়ে দিল হাত বিশেক দূরে। আমরা ভাবলাম মরেই গেল বোধহয়। কিন্তু রানি সামলে নিল। তার পর উঠে দাঁড়িয়ে আচমকা সেই হাতির পিছনের পায়ে সজোরে কামড় বসালো।”
কাজ হল তাতেই। নিতান্তই এক দিশি ঘোড়ার কাছে এমন প্রত্যাঘাত বোধহয় আশা করেনি সে। পড়ি কি মরি করে ছুট লাগাল হাতি। অনিলবাবু বলেন, “সে এক দেখার মতো দৃশ্য। হাতি ছুটছে আর রানি তার পিছনে ধাওয়া করছে। হাতি শুঁড় দিয়ে কেরামতি করতে চাইলে জোড়া পায়ে লাথি কষিয়ে পাল্টা ফিরিয়ে দিচ্ছে রানি।” মিনিট দশেকের এই অসম যুদ্ধে রণে ভঙ্গ দিয়ে শেষ পর্যন্ত জঙ্গলে সেঁধিয়ে গিয়েছিল হাতি। আর রানিকে জাপ্টে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন সোনামনির বাবা।
এই সেই রানি। —নিজস্ব চিত্র
ঘোর জঙ্গুলে গ্রাম পিড়রাগোরা উজিয়ে আশপাশের গ্রামেও রানির কদর ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। ইটভাটার মালিক অনিলবাবু বলেন, “হাতি ঢুকলেই আশপাশের ভুনারা, বারোবেলিয়া, আয়না-র গ্রামবাসীরা ছুটে আসেন। তখন কি, ঘোড়া দেব না বলা যায়? হাতি তাড়াতে তাঁরাও রানিকে নিয়ে যান।” রানি এখন এমনই পাঁচ গ্রামের ভরসা।
গত বছর এমনই এক হস্তি-হানায় একেবারে সামনে পড়ে গিয়েছিলেন ভুনারা গ্রামের নফর সিংহ সর্দার। এখনও সে কথা বলতে গিয়ে গলা কাঁপে তাঁর, “বাপরে বাপ। হাতি শুঁড় দুলিয়ে এগিয়ে আসছে, কোনওক্রমে একটা কালভার্টের নীচে লুকিয়ে আছি। এমন সময় দেখলাম পিড়রাগোরা থেকে কেউ এক জন রানিকে এনে ছেড়ে দিয়েছেন। টগবগিয়ে এগিয়ে এসে দু-পা সামনে তুলে হাতির পেটে লাথি কষালো সে। আর তার পরেই কামড়। দু-এক বার মৃদু প্রতিবাদ করে রানির তাড়ায় ছুট লাগাল সে।” স্থানীয় কোষ্ঠিয়া পঞ্চায়েত প্রধান সিপিএমের সাকিনা বিবিও বলছেন, “হাতির হানা থেকে গ্রাম বাঁচাতে এখন রানির জুড়ি মেলা ভার!”
কিন্তু হাতি তাড়াতে ঘোড়া?
বিশিষ্ট হস্তি বিশেষজ্ঞ ধৃতিকান্ত লাহিড়ি চৌধুরীর জবাব, “বড় দাঁতাল হলে ওই ঘোড়ার কী হাল হবে জানি না, তবে অনেক সময়ে অচেনা জন্তুর অপ্রকৃতস্থ ব্যবহারে ভড়কে গিয়ে হাতি পিছু হটলেও হটতে পারে।” অনাথ হস্তি শাবকদের নিয়ে কেনিয়ায় একটি সংস্থা চালান ডেভিড শেলড্রিক। তাঁর অভিজ্ঞতা: “জেব্রার কামড়কে শুধু শাবকেরা নয় পূর্ণ বয়স্ক হাতিও যে এড়িয়ে চলে তা আমার নিজের চোখে দেখা। ঘোড়া তো জেব্রার দোসর ভাই, তাই হতেও পারে।” প্রত্যন্ত সেই গ্রামে, পড়ন্ত বিকেলে এখন তাই হামেশাই--রানি ছুটছে, হাতি পালাচ্ছে আর, বেলবনি হাসছে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.