|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
একটা মুখ ভাবায় |
দরিদ্র মানুষ প্রতিবেশীর ভরসায় খড়কুটো ধরে বাঁচার লড়াই করেন।
বিশ্বাস ভেঙে তছনছ হলে সমাজ দাঁড়ায় কোথায়? ত্রস্ত প্রশ্ন তুলেছেন
গৌতম ভদ্র |
গত দু’সপ্তাহ ধরে একটা মুখ মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে, বাগুইআটির বাসিন্দা এক বাচ্চা মেয়ের কান্নাভেজা অসহায় মুখ, ২১ এপ্রিল রোববার সকালের কাগজে দেখা। স্মৃতিতে থাকা আমার বাচ্চা মেয়ের মুখ আর ছোট দীপিকার মুখ মিলেমিশে একাকার। দীপিকার বাবা এত দিন রিকশা চালাতেন, সৎ লোক বলে এলাকায় তাঁর নাম আছে। ওই এলাকার গরিবগুর্বো লোকদের অল্প টাকা ও নিজের সঞ্চয় এক করে জমা দিয়ে সারদা ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের এজেন্ট হয়েছেন। এক ছেলে ও এক মেয়ের পড়ার খরচ টানতে হবে। ১৬ এপ্রিলের পর সব গিয়েছে, দু’দিন ধরে তিনি নিপাত্তা। প্রতিবেশীরা ‘চোর’ বলে গালি দিচ্ছে, বাড়িতে হুজ্জতিও করেছে। বাচ্চা দীপিকা ভাবতেই পারে না যে, তার নির্বিরোধ বাবা চোর, আর এত দিনকার স্নেহশীল কাকু-কাকিমারা এতটা হিংস্র হতে পারে। শৈশবের নিরাপত্তা ও আস্থার জগৎটা একেবারে টাল খেয়ে গিয়েছে, আতঙ্কে ও শঙ্কায় দিনরাত কাটছে। |
|
আমার নিজের দিন স্বাভাবিক ভাবে কাটছে, টিভি কোনও দিনই দেখি না। রেডিয়ো শুনি না। কেবল একাধিক খবরের কাগজের পাতা ওল্টাই, অক্ষর, শব্দ ও কথার নানা মিছিল দেখি। মনে পড়ে, চল্লিশের দশকে বাংলার দেশি ব্যাঙ্ক ফেলিয়োর ও তহবিল তছরুপের কাহিনি, খেয়ালে আসে শঙ্করনারায়ণ ব্যাঙ্কের মতো ছবির ডায়লগ আর ‘মহানগর’ ছবির দৃশ্য, টাকা চোট যাওয়ায় শ্বশুর ও জামাইয়ের বিখ্যাত সংলাপ। ‘সঞ্চয়িতা’ ও ‘ফেভারিট স্মল স্কিম’ তো সে দিনের কথা। একই গল্প যেন অন্য নামে বার বার পড়ে চলছি, প্লটটা একই, কেবল দেশ ও কালের ফেরে মাত্রা ও রং চড়েছে। মহাবিদ্যার সাধনায় দেশে-বিদেশে আমাদের রজত, সুব্রত ও সুদীপ্তরা সামনের সারিতে জায়গা পাচ্ছেন, করিতকর্মা বাঙালি হিসেবে আমাদের পুলকিত হওয়ারই কথা। অবশ্যই চলছে চাপানউতোর। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু যে কত বার আওড়ানো হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা ও আইনি সুরক্ষা মজবুত করার জোর তোড়জোড় চলছে, কমিশন বসেছে। ঠিক কেউ জানে না কী হচ্ছে, তবে সবাই বুঝছে ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’। ঠকামির সঙ্গে মিশছে নানান রাজনৈতিক নষ্টামি।
এই শব্দের মিছিলের ফাঁকে ফাঁকে ভেসে ওঠে দীপিকার মতো নানা মুখ। মুখগুলি মনে করায় যে, পশ্চিমবঙ্গের হতদরিদ্র সাধারণ মানুষ ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের খেটেখাওয়া লোকেরা কী ভাবে সামূহিকতায় আস্থা রেখে, চেনাজানা প্রতিবেশীর সহমর্মিতার ভরসায় খড়কুটো ধরে বাঁচার লড়াই করেন। এই লড়াই দৈনন্দিনের। এই সায়েন্স সিটির কাছেই ঝুপড়ি, একরাশ নেই-মানুষদের আড্ডা। সব রকম প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগসুবিধে থেকে বঞ্চিত ঝুপড়ির বাসিন্দারা বস্তির নেতার মাধ্যমে তাদের দৈনিক সঞ্চয় অল্প মেয়াদের জন্যই সারদা প্রকল্পে রেখেছিল। থোক টাকা পেলে সবাই মিলে প্লাস্টিকের ছাউনি সরিয়ে এই বর্ষাতেই টালির ছাদ করবে, পাকা বাসিন্দা হিসাবে থানায় ফি দিয়ে পরিচিতি-পত্র পাবে। সব গিয়েছে। মেদিনীপুর গ্রামের এক চাঁদসির ডাক্তার, সবাই বিশ্বাস করে। |
|
তাঁর কাছেই লোকে অল্পবিস্তর টাকা গচ্ছিত রাখে। ওই টাকা আর নিজের টাকা মিলিয়ে সবই সারদা প্রকল্পে ছিল। কারও কারও মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সুবিধে হবে। টাকা আর ফেরত পাওয়া যাবে না, ডাক্তারের মুখ দেখাবার উপায় নেই। আত্মহননটাই তিনি বেছে নিলেন। দুর্গাপুরের কাঠমিস্ত্রি যাদব মাঝিকে তাঁর আশ্রয়দাতা ছেলের মতো বিশ্বাস করতেন। তাঁরাও গরিব, ভালর জন্যই বুড়োবুড়ির টাকা চিট ফান্ডে দেওয়া। বিশ্বাস গিয়েছে, মুখ দেখাবে কী করে, যাদব স্বচ্ছন্দে নিজে নিজে লাশকাটা ঘরে চলে গেল।
এজেন্টের আত্মহত্যায় বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা নয়, বরং আরও সর্বনাশ। তবে আশা এবং আশাভঙ্গের এই সব কাহিনি থেকে বুঝি যে, নৈমিত্তিক জীবনের চাপে বাঁচার তাগিদেই এই লোকেরা যুক্তি করে কোনও না কোনও বিশ্বাসের সূত্রে অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়েছিলেন। ওই ঝুঁকির দায় সামলাবার বোঝাতেই তাঁরা চরম বিপর্যস্ত, কেউ কেউ আত্মঘাতী, এখন চার পাশের সমাজ ও বন্ধুই বিশ্বাসহন্তা মনে করছে, বাঁচার সামূহিক ভরসা আর নেই। যুক্তিবোধ আর পারস্পরিক দায়বোধের অন্বয়েই গড়া মানুষের সামাজিক জীবন। এই অন্বয় বেশির ভাগ সময়ই অসম, প্রকারভেদও আছে। কিন্তু সাধারণের অন্বয়বোধটুকু বাতিল হলে সমাজই টেকে না।
এই প্রেক্ষিতে সারদা কাণ্ডকে ঘিরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের যে বুদ্ধিজীবী প্রতর্ক গত পক্ষকাল ধরে পড়ছি, তাতে এই অন্বয়বোধটাকেই অচ্ছুত করে রাখা হয়েছে, কোথাও কোথাও এই সমস্যাটাকেই ধুয়েমুছে সাফ করার চেষ্টা রয়েছে। ফলে, এই প্রতর্কের ভাষার মতো ‘ইনসেনসিটিভ’ বা নিষ্করুণ ও নির্দয় ভাষা আমি সাম্প্রতিক কালে আর পড়িনি। বলা হচ্ছে যে, মানুষরা ‘স্বভাবলোভী’ ও বোকা, প্রবঞ্চকরা ফাঁদ পেতে আছেন, এই রকম ঘটাই তো ‘স্বাভাবিক’। প্রতারকরা আছে ও থাকবে, বাজারি অর্থনীতির অঙ্গ তারা। কেবল সরকারি আইন শক্ত হবে, ‘সচেতনতা’ বাড়িয়ে বোকাদের বুদ্ধিমান করতে হবে, ‘রাজনৈতিক ড্যামেজ’-এর ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হবে, তবে আপাতত কেল্লা ফতে। আইন তো নৈর্ব্যক্তিক, তার ধারায় ও উপধারায় ব্যক্তিগত বিনিয়োগের সুরক্ষার যাবতীয় কবচ থাকবে। ব্যক্তিগত আস্থার খেয়ালিপনা ও অস্থিরতা দূর হবে, আর্থিক ক্ষতিপূরণের নীতিও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। এ একেবারে কাছারির কড়াক্রান্তির আঙ্কিক হিসেবনিকেশ। এই ধরনের ভাষা ও বিশ্লেষণের তন্তু দিয়ে যে সমাজভাবনার অবয়ব তৈরি হয়, তাতে রোবটদের কাজ চলে, মানুষের নয়। কাম, লোভ ইত্যাদি মানুষের চিত্তবৃত্তি, ওই বৃত্তির জালেই মানুষ নানা কর্মে জড়িয়ে পড়ে, সমাজ-সংসার বানায়, ওই সব প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষের তহবিল করা আর ঝুঁকি নেওয়া, আশা করা ও ভবিষ্যৎ ভাবা। রিপুর প্রতিক্রিয়া থেকেই উঠে আসে আস্থা, আনুগত্য ও বিশ্বাসের নানা বৃত্ত, রাগ-বিরাগের নানা বলয়। ওই বৃত্তিগুলির পরিচিতিতে কোন ব্যক্তি হয় মানুষ বা অ-মানুষ; কোন ক্যালকুলাসের ভাষায় এই হয়ে ওঠার সমস্যা ধরা পড়বে? এই সব বুঝেই তো উনিশ শতকে কমলাকান্ত নামে এক আফিমখোর অভিনব হিসেবখাতা বা ‘পে-বিল’ তৈরি করেছিল, সাহেবের হুকুমে তার চাকরি যায়। উপনিবেশের দিনগুলিতে ‘চিত্তবৃত্তি’র ভাষা তৈরি ছিল তার সাধনা, তার নিজের ‘লোকাল’ বা স্থান সে ওই ভাষায় তৈরি করার চেষ্টা করত। আজকের গোলকায়নের দিনে ওই চিত্তবৃত্তির ভাষা ও জায়গা খুঁজে পাওয়ার বোধ হয় দরকার নেই। বরং আস্থা ও বিশ্বাসের ছোট ছোট সামূহিক বোধগুলি ভেঙে দেওয়াই কাম্য। ‘গ্লোবাল’ তার মতো করে ‘লোকাল’ তৈরি করবে, একটানি উন্নয়নী ব্যাখ্যায় আর কোনও খিঁচ থাকবে না।
দীপিকার মুখের পাশে একটা হদ্দ বোকা বুড়োর মুখ উঁকি মারে, এক সময় তাকে বাপুজি বলে চিনতাম। সে ফিসফিস করে বলল, আরে আমার কথাই বলছ, করা বা লেখা যাচাই করার আগে তো আমি মুখের কথাই ভাবতে বলি। তোমার দেখা সবচেয়ে নিঃসহায় করুণ মুখটা ভেবে নিয়ে নিজেই প্রশ্ন করবে, এই লেখা বা আমার অন্য যে কোনও কাজ ওই মুখটিতে কি হাসি ফোটাবে, তাকে মুহূর্তের জন্যও স্বস্তি দেবে? উত্তরটা খুঁজছি, পাচ্ছি না, পেলেই বাপুজিকে জানাতে হবে। |
কৃতজ্ঞতা: ‘দ্য টেলিগ্রাফ’, ২১-৪-২০১৩ |
|
|
|
|
|