আমেরিকা ও কানাডায় সমীক্ষা চালাইয়া দেখা গিয়াছে, অধিকাংশ অফিসকর্মী অফিস চলাকালীন ফেসবুক বা অন্যান্য ভার্চুয়াল-আড্ডাখানায় অবাধ ও ব্যস্ত বিচরণকে কোনও রূপ অন্যায় তো মনে করেনই না, বরং তাঁহাদের ‘অধিকার’ মনে করিয়া থাকেন। বহু ছাত্রের যেমন স্কুলে ঢুকিয়াই ক্ষুধা পাইয়া যায় এবং প্রথম ঘণ্টা হইতেই লুকাইয়া টিফিনটি খাইতে শুরু করে, তেমনই, বিশ্ব জুড়িয়া এখন অফিসে ঢুকিয়াই নিজস্ব কম্পিউটারে ফেসবুক খুলিয়া বসিয়া পড়ার প্রবণতা লক্ষিত। কেহ অফিসের কর্মসময়ে নাটক দেখিলে তাহা যদি নিন্দনীয় হয়, ফেসবুক করিলে তাহা হইবে না কেন? কারণ, দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষের মতে, ফেসবুক বস্তুটি মনুষ্যের শ্বাসপ্রশ্বাস বা প্রাকৃতিক ক্রিয়ার মতোই অবধারিত ও স্বাভাবিক। কেহ বারংবার হাঁচিতেছে এবং মূল্যবান কর্মমুহূর্তগুলি নাসিকা দিয়া সবেগ উড়াইয়া অপচয় করিতেছে এই অভিযোগে তো মানুষকে বরখাস্ত করা যায় না। যেমন কাজ করিতে করিতে উঠিয়া বারান্দায় গিয়া এক পেয়ালা কফি পান, বা পার্শ্ববর্তী কিউবিক্ল-এ উঠিয়া গিয়া সহকর্মীর সহিত কিঞ্চিৎ বাক্যালাপ, তেমনই কর্মের সহিত বিশ্রামের ওতপ্রোত সম্পর্কের বয়ন-যুক্তির তোরণ দিয়া ফেসবুক সুচ-সুচ ভঙ্গি লইয়া প্রবেশ করিতেছে, নিষ্ক্রমণ-কালে সে ফাল-মূর্তি ধারণ করিবে কি না, তর্কের বিষয়। এই যে ফেসবুককে একটি অদাহ্য অকাট্য জীবনাংশ ধরিয়া চলা হইতেছে, এই ধারণার মূলে আঘাত কেহ করে না, বোধহয় নিজ ফেসবুক অ্যাকাউন্টটিতে বান্ধবের আকাল পড়িয়া যাইবে, এই ভয়ে। কিন্তু একটি অভ্যাস সর্বজনীন হইলেই তাহা প্রশ্নাতীত রূপে গৃহীত হইতে পারে না।
অধিকাংশ মানুষ ক্রমাগত কাজ না করিয়া প্রায়ই সামান্য ঘুরিয়াফিরিয়া লয়, কারণ এই সামান্য শিথিলতা ও অবসর তাহার কর্মের পরবর্তী পর্যায়ে মনোযোগ বর্ধিত করে। কিন্তু তাহা বলিয়া কাহারও অনন্ত ঘোরাঘুরি বা হইহই করিয়া আট ঘণ্টা ইয়ার্কি দিয়া বেড়াইবার দস্তুরকে অধিক দিন সহ্য করা হইবে না, কর্তৃপক্ষ কৈফিয়ত তলব করিবেন। কর্মের অপেক্ষা তাহার বিশ্রাম বহু গুণ হইয়া যাইতেছে যে। ফেসবুক এই মনোভঙ্গিটিকেই প্রশ্রয় দেয়। ‘এই আমি ডান দিকে তাকাইলাম’ ইহাও সেই সাইটে পোস্ট করা যায়। ‘পরক্ষণেই বাম দিকে তাকাইলাম’ও করা যায়। একটি দুইটি নয়, সেই স্থানে দলে দলে সরল-তরল বন্ধু অপেক্ষমাণ। তাহারা মন্তব্যের উত্তর দিবে, নিজেদের নূতন মন্তব্য করিবে, ছবি পোস্ট করিবে, সহস্র কেচ্ছা পরিবেশন করিবে। উপরভাসা এই বিলাসে দেখিতে দেখিতে সময় গড়াইয়া যাইবে। এবং যেহেতু অফিসের বস এই অবান্তর আড্ডার কাল বা মনোযোগ-তীব্রতা মাপিতে পারিতেছেন না, ইহা নিজ টেবিলে বসিয়া নীরবে করিয়া যাওয়া চলে পর্যবেক্ষণ-পরিধির অন্তরালে থাকিবার অভয় লইয়া এই স্পৃহা লাফাইয়া বাড়িবে। সর্বোপরি, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট জীবনের অবশ্যম্ভাবী অঙ্গ নহে, ইহা খুচরা-পনার এক সাম্প্রতিক ফ্যাশন মাত্র, যাহা জীবনের গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মের পরিপন্থী। সংখ্যাধিক্য দিয়া এই কু-রেওয়াজকে সিদ্ধ করিয়া লওয়া চলে না। অফিসের প্রতিটি কর্মী ধূমপায়ী হইলেও কর্তা অফিসে ধূমপান নিষিদ্ধ করিতে পারেন, কারণ এই অভ্যাস সামগ্রিক স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর। তেমনই, অংশীকে তুচ্ছতায় দীক্ষিত করিতেছে এবং আত্মপ্রয়োগের চর্চাটিকে বিনষ্ট করিতেছে বলিয়া ফেসবুক-ঢং অবশ্যই কর্মক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা যাইতে পারে। ইহা অধিকার নহে, দায়িত্বহীন আত্মপ্রশ্রয়প্রদান। তাই ‘ফেসবুক আমার কম্পিউটারগত অধিকার’ মন্তব্যটি ফেসবুক ব্যতীত অন্যত্র নম্বর পাইবে না! |