কর্নাটকে ভোট মেটার অপেক্ষা
ঘুষ-কাণ্ডে ইস্তফার খাঁড়া বনশলের মাথায়
‘মামা-ভাগনে যেখানে, বিপদ নেই সেখানে’ বহু দিনের পুরনো এই প্রবাদটা বিশেষ খাটল না রেলমন্ত্রী পবন বনশলের ক্ষেত্রে। তাঁর রেল মন্ত্রকে ভাগনে বিজয় সিঙ্গলার ছায়া পড়তে বিপদ ঘনালো দু’জনেরই। রেল বোর্ডের এক শীর্ষকর্তার কাছ থেকে ঘুষ নিতে গিয়ে শুক্রবার সিবিআইয়ের হাতে ধরা পড়ে ভাগনে বিজয় আপাতত সিবিআইয়ের হেফাজতে। পবনের মাথায় ঝুলছে ইস্তফার খাঁড়া।
এমনিতেই কয়লা দুর্নীতির সিবিআই তদন্তে নাক গলানোর অভিযোগে আইনমন্ত্রী অশ্বিনী কুমারের মাথার উপর খাঁড়া ঝুলছে। তার মধ্যেই রেলের ঘুষ-কাণ্ড! যার জেরে রেলমন্ত্রীর তো বটেই, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহেরও পদত্যাগের দাবি তুলেছে বিজেপি। পবন আজ নিজেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জানিয়ে দেন, তিনি পদত্যাগ করতে প্রস্তুত। বিকেলে এ নিয়ে কংগ্রেসের কোর গ্রুপের বৈঠক বসে। সেখানে পবন ব্যাখ্যা দেন, ভাগনের সঙ্গে তাঁর বিশেষ যোগাযোগ নেই। ভাগনের সঙ্গে তাঁর কোনও ব্যবসায়িক সম্পর্কও নেই। পবনের পদত্যাগ নিয়ে আজ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও কংগ্রেসের একটি সূত্র বলছে, রেলমন্ত্রীকে ইস্তফা দিতেই হবে। রবিবার কর্নাটকে ভোট। তার আগের দিন পবনকে পদত্যাগের জন্য চাপ দিয়ে আর বিড়ম্বনা বাড়াতে চায়নি সরকার। তবে ভোট মিটলেই পবনকে সরতে হবে বলে মনে করছে দলের একটি বড় অংশ। কিন্তু কংগ্রেসের অন্য একটি মহলের আশঙ্কা, পবনকে সরালে অশ্বিনী কুমারের পদত্যাগও অনিবার্য হয়ে পড়বে। তখন সরাসরি চাপ বাড়বে প্রধানমন্ত্রীর উপরে।
নিজের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন বনশল। শনিবার। ছবি: পিটিআই
রেল বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ পদের বিনিময়ে যে কোটি কোটি টাকার লেনদেন চলছে, এই ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। রেল মন্ত্রক যে দুর্নীতির আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে, আজ রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীও তা মেনে নিয়েছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, রেল বোর্ডের শীর্ষকর্তাই যখন বিশেষ একটি পদ পাওয়ার জন্য খোদ রেলমন্ত্রীর আত্মীয়কে ঘুষ দিচ্ছেন, তখন তিনি ফলের বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তবেই এগোবেন। যে পদ পাওয়ার জন্য একজন রেল-কর্তা দু’কোটি টাকা দিতেও তৈরি, সেই পদে কী পরিমাণ উপরি আয়ের সুযোগ রয়েছে, তা-ও অনুমেয়। এ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, রেল-কর্তাকে ঘুষের টাকা জোগাড় করে দিতে সাহায্য করেছেন রেলের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা। বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, “মনমোহন-সরকার একটা বাজারে পরিণত হয়েছে! এখানে টাকার বিনিময়েই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।”
রেল মন্ত্রক সূত্রের খবর, চণ্ডীগড়ে নির্মাণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও রেল মন্ত্রকে যাতায়াত ছিল বিজয়ের। সিবিআই আদালতে জানিয়েছে, তিন দিন আগে পশ্চিম রেলের জেনারেল ম্যানেজার থেকে পদোন্নতি হয়ে রেল বোর্ডের সদস্য (কর্মিবর্গ) হিসেবে যোগ দেন মহেশ। কিন্তু তার আগে থেকেই তিনি রেল বোর্ডের সদস্য হওয়ার জন্য চেষ্টা শুরু করেন। এই গদি পেতেই পবনের ভাগনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মহেশ। ঘুষের অঙ্ক নিয়ে দর কষাকষিতে মধ্যস্থতাকারীর কাজ করছিলেন হরিয়ানার ব্যবসায়ী সন্দীপ গোয়েল। রেলের যন্ত্রাংশ সরবরাহের সুবাদে তাঁর সঙ্গে রেল মন্ত্রকের অন্দরমহলের লোকেদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের দায়িত্ব পাইয়ে দেওয়ার জন্য মহেশ কুমারের কাছে ১০ কোটি টাকা চাওয়া হয়।
এই দর কষাকষির মধ্যেই রেল বোর্ডে পদোন্নতি হয় মহেশের। তখন তিনি সন্দীপের মাধ্যমে বিজয়কে অনুরোধ করেন, ইলেট্রিক্যালের দায়িত্ব না পাওয়া পর্যন্ত তাঁকে যেন একই সঙ্গে পশ্চিম রেলের জেনারেল ম্যানেজার এবং সিগন্যাল ও টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর বিনিময়ে দু’কোটি টাকা দিতেও রাজি হন মহেশ। ওই টাকা জোগাড় করে দেওয়ার জন্য মহেশ বেঙ্গালুরুর একটি বেসরকারি সংস্থার কর্তা নারায়ণ রাও মঞ্জুনাথকে অনুরোধ করেন। মঞ্জুনাথের সংস্থাও রেলের যন্ত্রাংশ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। মঞ্জুনাথই ৯০ লক্ষ টাকা জোগাড় করে চণ্ডীগড়ে নিয়ে যান। সেখানেই সিবিআই তাঁকে ধরে। রাতেই মহেশকে মুম্বই থেকে গ্রেফতার করা হয়। বিজয়, সন্দীপ গোয়েল, মঞ্জুনাথ-সহ মোট আট জনকে দিল্লি ও চণ্ডীগড় থেকে ধরা হয়। আজ দিল্লিতে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতে পেশ করার পর তাঁদের চার দিনের সিবিআই হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেয় আদালত। তাঁদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির অধীনে ফৌজদারি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ও দুর্নীতি দমন আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। শনিবারই মহেশকে সাসপেন্ড করেছে রেল মন্ত্রক।
এই ঘটনায় সিবিআইয়ের অতি সক্রিয়তা নিয়েও জোর আলোচনা চলছে। মঙ্গলবারই কয়লা খনি বণ্টন কেলেঙ্কারি তদন্তে সিবিআইয়ের কাজে মনমোহন-সরকারের হস্তক্ষেপ নিয়ে কড়া মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্ট। এই ঘটনায় মাধ্যমে তাই সিবিআইয়ের নিরপেক্ষতা প্রমাণের চেষ্টা হচ্ছে কি না, সেটাও আলোচনার বিষয়। আজ অধীর চৌধুরী সেই দাবি করেই বলেন, “শাসক দলের কথায় যে সিবিআই চলে না, অন্তত এটা থেকে তা স্পষ্ট।” তবে এই ঘটনা যে রেলের কাছে অস্বস্তিকর, তা তিনি মানছেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “সিবিআই-এর তদন্তে কখনও কংগ্রেস হস্তক্ষেপ করে না। এ ক্ষেত্রেও সিবিআইয়ের তদন্তে দোষ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তের শাস্তি হবে।”
রেলে দুর্নীতি নিয়ে তৃণমূলকে নিশানা করে অধীরের অভিযোগ, “তৃণমূলের আমলেই রেলে সবথেকে বেশি দুর্নীতি বাসা বেঁধেছিল। বহু ব্যক্তিকে নিয়ম ভেঙে পদে বসানো হয়েছে।” কিন্তু তৃণমূলের তরফে রাজ্যসভায় দলের মুখ্য সচেতক ডেরেক ও’ব্রায়েনের মন্তব্য, “মমতাদি রেলে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করেছিলেন। তা চলে যাচ্ছে দেখে আমরা দুঃখিত।” তৃণমূলের দাবি, রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করুন। ডেরেকের কটাক্ষ, “আমি ওঁর জায়গায় হলে তাই করতাম। কিন্তু কংগ্রেসের মন্ত্রীরা চেয়ারে বসার আগে ফেভিকল লাগিয়ে নেন বলে মনে হচ্ছে!” প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীরও যুক্তি, “সিবিআই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত রেলমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত।” তৃণমূল বিষয়টি নিয়ে সংসদেও সরব হতে চায়। দলীয় সূত্রের খবর, সোমবারই প্রশ্নোত্তর পর্ব সাসপেন্ড করার জন্য নোটিস দেবেন দলের রাজ্যসভা সাংসদ দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়।
রেলন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে সিপিএমও। তাদের বক্তব্য, রেলমন্ত্রীর সরাসরি যোগাযোগের প্রমাণ না মিললেও নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে তাঁর পদত্যাগ করা উচিত। একই দাবি বিজেপিরও। শনিবার কলকাতায় দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি এস এস অহলুওয়ালিয়া বলেন, “কয়লা কেলেঙ্কারির জন্য প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ চাইতে কলকাতায় আসছিলাম। পথেই আর একটা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এল। রেলমন্ত্রীর আত্মীয় ঘুষ নিয়েছেন। তাই রেলমন্ত্রীরও পদত্যাগ চাইছি।”
আজ কংগ্রেসের সদর দফতরে এক এআইসিসি নেতা বলেই বসলেন, “ঠিক এই সময়েই এমন কাণ্ড হওয়ার ছিল! টু-জি কেলেঙ্কারির জেপিসি রিপোর্ট নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। সংসদ অচল হয়ে রয়েছে। কয়লা কেলেঙ্কারির সিবিআই তদন্তে সরকারের নাক গলানো নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কড়া প্রশ্ন তুলেছে। এর মধ্যে আবার পবন বনশলের ভাগনে! এ তো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা!”

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.