সারদা কাণ্ডের তদন্তে নেমে এখনও টাকা উধাওয়ের গোলকধাঁধায় পাক খাচ্ছে পুলিশ। বিধাননগর কমিশনারেটে এক দিকে জমছে দিস্তা দিস্তা ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, অন্য দিকে সারদার একাধিক সংস্থা
ও তাদের লেনদেনের জটিল হিসেব কষতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছেন গোয়েন্দারা। সেই কারণে সারদার টাকার হদিস পেতে একটি চাটার্ড অ্যাকাউন্টিং ফার্মকে নিয়োগ করেছে পুলিশ। সাহায্য নেওয়া হচ্ছে
সারদার ব্যাঙ্কিং অপারেশনস বিভাগের কর্মীদেরও।
কেন এই জটিলতা?
পুলিশ সূত্রের খবর, তদন্তে নেমে এখনও পর্যন্ত প্রায় ২৩০টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের হদিস পেয়েছেন তদন্তকারীরা। তার মধ্যে এ পর্যন্ত ১৮০টির স্টেটমেন্ট পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সে সব দেখে হতবাক গোয়েন্দারা। এক পুলিশকর্তা বলেন, “১৮০টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মাত্র দেড় থেকে দু’কোটি টাকা পড়ে রয়েছে!” তা হলে বিপুল পরিমাণ টাকা গেল কোথায়?গোয়েন্দাদের সন্দেহ, ওই অ্যাকাউন্টের টাকা অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং তা নিয়ে কিছু সূত্রও পেয়েছে পুলিশ। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, সারদার বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে কয়েকটি সংস্থায় টাকা ‘অ্যাডভান্স’ করা হয়েছে। কিন্তু কেন, তা এখনও জানতে পারেননি তদন্তকারীরা। পুলিশের সন্দেহ, ওই সব সংস্থার মাধ্যমেই আমানতকারীদের জমানো টাকা অন্যত্র সরানো হয়েছে। তাই প্রতিটি অ্যাকাউন্ট আলাদা করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। এক গোয়েন্দাকর্তা জানান, এ ভাবেই শিকড়ে পৌঁছনোর চেষ্টা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই গোয়েন্দারা জেনেছেন, রাজনৈতিক নেতা-আমলা-পুলিশ মিলিয়ে বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকা খরচ করত সারদা গোষ্ঠী।
পুলিশ জানিয়েছে, সারদা গোষ্ঠীর টাকা বিদেশের কোনও ব্যাঙ্কে জমা থাকতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর মিলছে। সংস্থার অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মীরা জানান, তাঁদের কাছে অনেক সময়ই কাগজপত্র আসত না। সেই জন্যই গত দু’বছরের কোনও হিসেবের খাতা বা ব্যালান্স শিট পায়নি পুলিশ। ওই সংস্থার সফটওয়্যারের খুঁটিনাটি জানতে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলছে পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে যে তথ্য মিলবে, তা নিয়ে ফের সুদীপ্তকে জেরা করা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশি জেরা ও সিবিআইকে লেখা চিঠিতে সংবাদমাধ্যমে টাকা ঢেলে ভরাডুবির কথা একাধিক বার বলেছেন সারদা কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। তদন্তে নেমে তার কিছু প্রমাণও পেয়েছেন গোয়েন্দারা। পুলিশ সূত্রের খবর, অসমে একটি টিভি চ্যানেলের প্রচারের ধাক্কায় ব্যবসায়িক ভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন সুদীপ্ত। তার পাল্টা হিসেবেই তিনি একটি সর্বভারতীয় নিউজ চ্যানেল খুলতে চেয়েছিলেন। প্রাথমিক ভাবে বিনিয়োগও করেছিলেন প্রচুর টাকা।
কাঁথি ও বনগাঁয় সারদার বেশ কিছু জমির খোঁজ পেয়েছে পুলিশ। ওই সব জমিতে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল বলে জেরায় জানিয়েছেন সুদীপ্ত। বারাসতে একটি বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সে অফিস খোলার জন্য অনেকটা জায়গা নেওয়া হয়েছিল বলেও পুলিশ জেনেছে।
সারদা কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ দিনই প্রথম বৈঠকে বসেন বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) সদস্যরা। হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা, বর্ধমান-সহ বিভিন্ন জেলার এসপি, ডিআইজি ও আইজি-রা ভবানী ভবনের এই বৈঠকে ছিলেন। বৈঠকে ঠিক হয়েছে, লগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ মিললেই সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থার অফিস বন্ধ করে দিতে হবে। পাশাপাশি মামলা ও তদন্তের বিষয়ে যে কোনও পদক্ষেপ করার আগে সিট-কে তা জানাতে বলা হয়েছে। জেলায় কোনও মামলা হলে তা সঙ্গে সঙ্গে সিট-কে জানাতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সিআইডি-র চার স্পেশ্যাল সুপারিন্টেনডেন্টকে। সিআইডি-র স্পেশ্যাল সুপারিন্টেনডেন্টরা একাধিক জেলার দায়িত্বে থাকেন। প্রত্যেক সুপারিন্টেনডেন্ট নিজেদের জেলাগুলির মামলার দেখভাল করবেন। প্রতি ক্ষেত্রেই সিট-এর সঙ্গে সমন্বয় রাখতে জেলা পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সিট সূত্রের খবর, এ পর্যন্ত বিভিন্ন লগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে প্রায় ১৩০টি মামলা হয়েছে। সেগুলি নিয়েও আলোচনা করেন পুলিশ কর্তারা। পুলিশ সূত্রের খবর, সারদা কাণ্ডে বিভিন্ন জেলায় মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুদীপ্ত সেনকে নিজেদের হেফাজতে নিতে পারে জেলা পুলিশ। কোন জেলা তাঁকে হেফাজতে নেবে, সেটা সিট-ই ঠিক করে দেবে। |