লম্বা ঘাসভর্তি মাঠের মাঝে একটা ঝাঁ চকচকে চারতলা বাড়ি। সদর দরজায় তালা দেওয়া। আশপাশে জনমনিষ্যি নেই।
বিশাল জমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বেশ কিছু বাড়ি আর ছোট ছোট মন্দির। পাঁচিল ঘেঁষে গুটি কয়েক ‘কটেজ’। তার মধ্যে দু-একটিতে লোক এলেও বেশির ভাগই খাঁ খাঁ করছে।
ছবিটা দক্ষিণ শহরতলির বিষ্ণুপুরের একটি আবাসন প্রকল্পের, যার পোশাকি নাম ‘সারদা গার্ডেন’। এবং এই প্রকল্প থেকেই উত্থান আজকের সারদা গোষ্ঠীর। অভিযোগ, এমন প্রকল্প দেখিয়েই বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা তুলেছে সারদা রিয়েলটি ইন্ডিয়া নামে সংস্থাটি। বলা হয়েছিল, আমানতকারীদের লগ্নি করা টাকা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আবাসন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হবে। সেই সূত্রেই প্রশ্ন উঠেছে, কতটা এগিয়েছিল সারদা গার্ডেনের কাজ?
গার্ডেনে রাস্তার পাশে ধূ-ধূ মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাড়ি দেখিয়ে সংস্থারই এক কর্মী বলেন, “ওটাই সারদা গার্ডেনের হাউসিং প্রোজেক্ট। কিন্তু কেউ থাকে না সেখানে।” পাশের কটেজগুলির বাসিন্দারা কেউ কথা বলতে রাজি নন। হাজার ডাকাডাকিতেও কেউ সাড়া দিলেন না। কিন্তু যে জমিগুলি ফাঁকা পড়ে, তার রহস্যটা কী? পুলিশ সূত্রের খবর, একই জমি অন্তত ১০ জনকে বিক্রি করা হয়েছে। সবার কাছেই কাগজপত্র রয়েছে। কিন্তু তা দেখিয়ে কেউই দখল পাবে না সেই জমির। |
সারদার কয়েক জন কর্মীর সঙ্গে কথা বলতেই বেরিয়ে এল ওই কারবারের গোপনকথা। তাঁরা জানান, ১৯৯৯ সাল থেকে বিষ্ণুপুরের ভাসা, বাগী ও উত্তর গৌরীপুরে কম দামে কেনা অথবা জোর করে দখল করা জমির উপরে কয়েকটি বাড়ি করেছিল সারদা গোষ্ঠী। আর ওখানেই শেষ। তার পরে সেই বাড়ি ও সংলগ্ন ফাঁকা জমিই দেখানো হত বিনিয়োগকারীদের। বলা হত, ওই সব জমি কিনে নিয়েছে সংস্থা। বাড়ি তৈরির জন্য বাজার থেকে টাকা তোলা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের টাকায় বাড়ি তৈরি করা হবে। তার পরে চড়া দামে বেচে সুদ সমেত টাকা ফেরত দেওয়া হবে বিনিয়োগকারীদের। সারদা গার্ডেনের এক প্রাক্তন কর্তার কথায়, “এখানে টাকা দিয়ে জমি বা ফ্ল্যাট কিনে প্রতারিত হয়েছেন অনেকেই। মিলেছে মারধর, এমনকী খুনের হুমকিও।” এমনই এক ঘটনার সাক্ষী উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা, এক স্কুল শিক্ষিকা।
ওই শিক্ষিকা জানান, বিজ্ঞাপন দেখে তিনি সারদা গার্ডেনে তিন কাঠা জমি কিনেছিলেন। তার মূল্য চোকাতে দু’বারে মোট ২৪ লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছিলেন সারদা গোষ্ঠীর হাতে। বদলে হাতে পেয়েছিলেন একফালি সাদা কাগজ। সেটাই ছিল জমির মালিকানা।
বেহালায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে বসে ওই শিক্ষিকা বলেন, “বহু বার ওদের কাছে জমির দলিল চেয়েছি। গালাগালি করে তাড়িয়ে দিয়েছে।” তাঁর অভিযোগ, ক্ষোভে প্রকাশ্যেই তিনি বিষয়টি পুলিশে জানানোর কথা বলেছিলেন। পরের দিনই তাঁর উত্তর ২৪ পরগনার বাড়িতে গিয়েছিল এক দল দুষ্কৃতী। কপালে রিভলবার ঠেকিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার পরে আর জীবনে পা দেননি সারদা গার্ডেনে।
এত কিছু পরেও কেন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন?
সারদা গার্ডেনে জমি কিনে প্রতারিত কয়েক জনের কথায়, “থানা থেকে বিডিও অফিস, সর্বত্রই ওদের লোক ছিল। অভিযোগ জানাতে গেলেই হুমকি দিত।” পুলিশেরও একাংশ বলছেন, তাঁদের কয়েক জন পদস্থ কর্তা নিয়মিত সারদা গার্ডেনে যেতেন। চাকরি খোয়ানের ভয়ে তাই কেউ ওই গোষ্ঠীকে ঘাঁটানোর সাহস পেতেন না। এখন স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, যে সারদা গার্ডেন এক সময় ছিল আতঙ্কনগরী, পয়লা বৈশাখের পরে আর সেখানকার মোটরসাইকেল বাহিনীর দেখা মিলছে না। কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন অধিকাংশ নিরাপত্তা রক্ষীও। |