বিশ্ব বাজারে মন্দা। সঙ্গে প্রবেশ কর-এর বোঝা। এই সাঁড়াশি চাপে জাপানি বহুজাতিক মিৎসুবিশি কেমিক্যাল কর্পোরেশনের নাভিশ্বাস উঠছে। শুধুমাত্র প্রবেশ কর দিতেই রাজ্যের এই ‘শো-কেস’ সংস্থার খরচ গত এক বছরে এক লাফে ৭০ কোটি টাকা বেড়ে গিয়েছে। এই বাড়তি খরচের বোঝা বাড়তে থাকলে পুরো মাত্রায় উৎপাদন চালু রাখা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যেতে পারে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
শুধু মিৎসুবিশিই নয়, প্রবেশ করের ধাক্কায় বেসামাল এ রাজ্যের অন্য পেট্রোপণ্য উৎপাদক সংস্থাগুলি। ধনসেরি পেট্রোকেমিক্যালসও আছে এই তালিকায়। এই সংস্থাগুলি বলছে, অর্থমন্ত্রী প্রবেশ কর থেকে চলতি বছরে রাজস্ব আয় বাড়িয়েছেন ঠিকই। কিন্তু বিশ্ব বাজারে মন্দার ধাক্কার উপরে বিষফোঁড়ার মতো এই কর যোগ হয়ে লগ্নিকারীদের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। কেন? তাঁদের বক্তব্য, কাঁচামালের উপরে এই কর বসানোর ফলে এ রাজ্যে উৎপাদনের খরচ অনেকটাই বেড়ে যাচ্ছে। তাতে দেশের অন্যান্য রাজ্যের উৎপাদকদের থেকে তাঁরা অনেকটাই পিছিয়ে পড়ছেন। তা সামলাতে এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার তাগিদে কোপ বসাতে হচ্ছে লাভের অঙ্কে। আর তাতে মার খাচ্ছে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা।
এ নিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে দরবার করছে বিভিন্ন বণিকসভা। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি বলেই অভিযোগ। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বিষয়টি দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।
এ রাজ্যে বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগ পেট্রোপণ্যেই। প্রায় ৫০টি দেশে ছড়িয়ে থাকা জাপানি সংস্থা মিৎসুবিশি কেমিক্যাল কর্পোরেশনের হাত ধরে। ২০০০ সালে হলদিয়ায় প্রথম কারখানা তৈরি করে তারা। ২০১০ সালে চালু হয় দ্বিতীয় কারখানা। দু’দফায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা লগ্নি করেছে তারা। এখানে উৎপাদন করা হয় পিউরিফাইড টেরিপথ্যালিক অ্যাসিড (পিটিএ)।
পিটিএ তৈরির মূল উপাদান প্যারাক্সিলিন আমদানি করা হয় সংস্থার সিঙ্গাপুর শাখা থেকে। এই প্রধান কাঁচামালের উপর এক শতাংশ প্রবেশ কর বসে যাওয়ায় বছরে প্রায় ৭০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে পণ্যের দামের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে সংস্থা সূত্রের খবর। আর সেই কারণে প্রতিযোগিতার বাজারে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যবসা করা এই সংস্থা।
এ দেশে মিৎসুবিশির মূল বাজার পশ্চিম ও উত্তর ভারত। যে বাজারে মুকেশ অম্বানীর রিলায়্যান্স ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন-এর জোরালো উপস্থিতি রয়েছে। গুজরাতে প্রবেশ কর থাকলেও কাঁচামাল আমদানির উপরে এই কর ছাড় দিচ্ছে সে রাজ্য। তা না হলে এই খাতে রিলায়্যান্সকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ করতে হতো বলে শিল্পমহল সূত্রে খবর। অন্ধ্রপ্রদেশও একই ভাবে উৎপাদন শিল্পকে প্রবেশ কর ছাড় দিয়েছে। কিন্তু এ রাজ্যে সেই সুবিধা না পেয়ে মিৎসুবিশি পিছিয়ে পড়ছে। একই সমস্যা হলদিয়ার আর এক পেট্রোপণ্য সংস্থা ধনসেরি পেট্রোকেমিক্যালসের। তাদেরও বক্তব্য, প্রবেশ কর বাবদ বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়তি প্রায় ১০ কোটি টাকা। ফলে বাড়ছে লোকসানের আশঙ্কা।
সিআইআই, ফিকি-সহ সব বণিকসভা এ নিয়ে রাজ্যের কাছে দরবার করে। অর্থমন্ত্রীকে একাধিকবার এই সমস্যার কথা জানানো হয় বলে তাদের দাবি। বণিকসভার এক কর্তার ক্ষোভ, কর্মসংস্থানের জন্য উৎপাদন শিল্পে লগ্নি টানা জরুরি। তাকেই করের ধাক্কায় দমিয়ে দেওয়া হচ্ছে!
মিৎসুবিশির সমস্যা নিয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূত তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী। তিনি বলেন, “অর্থমন্ত্রীকে সংস্থাটি চিঠি দিয়েছে। আমিও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। আমরা কখনওই চাইব না যে, মিৎসুবিশির মতো সংস্থার কোনও অসুবিধা হোক।” অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
উৎপাদন শিল্পের সঙ্কটের সঙ্গে কর্মসংস্থান ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সেখানে লগ্নিতে ভাটা, তাই টান পড়েছে কর্মসংস্থানেও। সরকারি, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে ‘প্লেসমেন্ট’-এর ধরনই জানিয়ে দিচ্ছে, অধিকাংশ স্নাতক ইঞ্জিনিয়ার কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে যাচ্ছেন। একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার সব স্নাতক পাড়ি দেন অন্য রাজ্যে। কারণ, এ রাজ্যে নতুন প্রকল্পের সংখ্যা তলানিতে। থমকে চালু সংস্থার সম্প্রসারণও।
সুতরাং শিরে সঙ্কট। |