পুস্তক পরিচয় ১...
কোনও প্রশ্নেরই উত্তর নেই
ইন্ডিয়া গ্রোজ অ্যাট নাইট, গুরচরণ দাস। পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া, ৫৯৯.০০
গুরচরণ দাস বেশ ভাল লেখেন। উদাহরণ হিসেবে তাঁর আগের দুটো বইয়ের কথা বলতে পারি ইন্ডিয়া আনবাউন্ড আর দি এলিফ্যান্ট প্যারাডাইম। তাঁর নতুন বই ইন্ডিয়া গ্রোজ অ্যাট নাইট-এর মূল প্রতিপাদ্য: ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির পথে বড় বাধা হল ভুলভাল সরকারি হস্তক্ষেপ। রাষ্ট্রীয় খবরদারি যত কম থাকবে, ভারতীয় অর্থনীতিও তত দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। দেশে বেসরকারি উদ্যোগের অভাব নেই। সরকার যদি অহেতুক নাক গলানো বন্ধ করে, এবং বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ তৈরির বাইরে আর কিছু করার চেষ্টা না করে, তবে এই বেসরকারি উদ্যোগগুলি ফুলে-ফলে বেড়ে উঠতে পারবে।
এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। বইটির নামকরণের কারণটাও এর থেকেই বোঝা যায়। সরকার দিনের বেলা কাজ করে, রাতে ঘুমোয়। বেসরকারি ক্ষেত্র রাতেও কাজ করে চলে, ফলে ভারতীয় অর্থনীতি রাতেই বৃদ্ধি পায়। গুরচরণের আগের বই দুটিতে যেমন ছিল, এই বইয়েও টুকটাক গল্পের ছড়াছড়ি। বইটি জুড়ে লেখক সরকারি আধিপত্য কমিয়ে বাজারমুখী ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে সওয়াল করেছেন। মুশকিল হল, এই বইটির পরিধি আগের দুটির তুলনায় অনেক বিস্তৃত গুরচরণ অনেক বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছেন। এই বইয়ে ‘শক্তিশালী রাষ্ট্রের পক্ষে উদারপন্থী যুক্তি’ রয়েছে। এই যুক্তির মূলে আছে বাজার ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস। এখানে ‘ক্যাপিটালিজম’ বা ‘ধনতন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করা ঠিক হবে না। যাঁরা বাজারে বিশ্বাসী, তাঁরা ধনতন্ত্র শব্দটি তেমন ব্যবহার করেন না। প্রধানত বামপন্থায় বিশ্বাসীরাই এই শব্দটি ব্যবহার করেন, সচরাচর বিদ্রুপ বা আক্রমণের হাতিয়ার হিসেবে।
যাঁরা বাজারে বিশ্বাসী তাঁদের মতে সম্পদের বণ্টন যখন বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে হয়, তখন কেবল পুঁজি নয়, উৎপাদনের সব উপাদানই অনেক কুশলী ভাবে ব্যবহৃত হয়। তাঁদের মতে, জমি, শ্রমিক, বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ, ব্যবসায়িক উদ্যোগ সব উপাদানের ক্ষেত্রেই কথাটা সত্যি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম দুনিয়ার নানা দেশের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রাখলে এই বক্তব্য উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হাজার হোক, সব বাজারই একটা নিয়ম মেনে চলে, একটা নিয়ন্ত্রক কাঠামোয় কাজ করে। আজ আমরা জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যতখানি নিয়ন্ত্রণ এবং কাঠামো মেনে চলার বাধ্যবাধকতা ছিল বলে আমরা ভাবতাম, আসলে ছিল তার চেয়ে কম। কিন্তু তাতে বাজারের কুশলতা অপ্রমাণিত হয় না, শুধু প্রতিষ্ঠিত হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাজারভিত্তিক কাঠামো থেকে খানিক বিচ্যুত ছিল।
বইয়ের কথায় ফেরা যাক। ‘উদারপন্থা’ নিয়ে খানিক কথা বললাম, এ বার ‘রাষ্ট্র’ বলতে ঠিক কী বোঝায়, সেই কথায় ঢুকি। ভারতীয় রাষ্ট্র ও তার অ(প)শাসন এবং দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে এই বইয়ে বেশ খানিকটা আলোচনা রয়েছে। বইয়ে উল্লেখ-করা অনেকের কথাতেই ‘শক্তিশালী রাষ্ট্র’ এবং ‘দুর্বল রাষ্ট্র’ শব্দবন্ধ দুটি ঘুরেফিরে এসেছে, কিন্তু এগুলোর মানে যে ঠিক কী, কোথাও স্পষ্ট হল না। গুরচরণ নিজেও ‘শক্তিশালী রাষ্ট্র’-এর কোনও ব্যাখ্যা দেননি। এই বইয়ে প্রচুর নেতিবাচক আলোচনা রয়েছে, যার প্রতিপাদ্য: ভারতীয় রাষ্ট্রের যা হওয়া উচিত ছিল, রাষ্ট্র তা হতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এই জাতীয় আলোচনা থেকে ঠিক কোথাও পৌঁছনো যায় কি না সন্দেহ। একটা উদ্ধৃতি দিই: ‘এই বইয়ে যে ধারণাগুলি ছড়িয়ে রয়েছে, সেগুলিকে একত্র করলে একটি ধ্রুপদী উদারপন্থী দলের মূল নীতি পাওয়া যেতে পারে ভারতের টলোমলো পায়ে এগিয়ে চলা রাষ্ট্রকে সেই দল আমূল বদলে দিতে পারে।’
হয়তো সত্যিই পারে। কেন কেউ একটি মধ্য-দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের পক্ষে সওয়াল করবেন, সেটাও বুঝতে কোনও অসুবিধে নেই। সমস্যা অন্য। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা (প্রিঅ্যাম্বল) সংশোধন করে ভারতকে একটি ‘সমাজতান্ত্রিক’ প্রজাতন্ত্র আখ্যা দেওয়া হয়। তার পর দ্য রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপলস অ্যাক্ট (আর পি এ) বা জনপ্রতিনিধিত্ব আইন সংশোধিত হয়। অতঃপর, কোনও রাজনৈতিক দল যদি সমাজতন্ত্রের নীতি মানতে অস্বীকার করে, তবে তা ভারতে নথিভুক্ত হতে পারবে না। পছন্দ হোক বা না-ই হোক, এটাই বাস্তব। কাজেই, গুরচরণ দাসের এই বইটির মতো একটি বইয়ের কাছে প্রত্যাশা থাকবেই, তাতে ওই আইন নিয়ে আলোচনা থাকবে, ‘সমাজতন্ত্র’ বলতে কী বোঝায় তার ব্যাখ্যা থাকবে। এই বইয়ে আর পি এ-র উল্লেখই নেই।
একটি ইতিবাচক এবং গঠনমূলক বইয়ের আরও একটি দায়িত্ব থাকেই আজকের ভারতের প্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের অর্থ কী, তা আলোচনা করা। সংবিধান ভারতীয় গণতন্ত্রের যে তিনটি স্তম্ভের কথা বলেছে, সেই আইন, শাসন এবং বিচারবিভাগ সম্পর্কে গভীর আলোচনা প্রয়োজন ছিল। এই বিভাগগুলি কী ভাবে কাজ করছে, কোথায় ঘাটতি থাকছে সেই বিশ্লেষণের অবকাশ ছিল। তার বদলে সংসদে অপরাধীদের আধিপত্য এবং আদালতে জমে থাকা মামলার পাহাড় বিষয়ে সরল, ভাসা ভাসা মন্তব্য করে বেরিয়ে গেলে সেই দায়িত্ব অস্বীকার করা হয়। বিকেন্দ্রীকরণ ও অবমূল্যায়ন নিয়ে গভীর আলোচনার প্রয়োজন ছিল, যা এখানে নেই। তার ফলে, বইটি মূলত নেতিবাচক।
তার মানে এই নয় যে, বইটি পড়ার প্রয়োজন নেই। বইটি অতি চমৎকার করে লেখা। কিন্তু যে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে লেখা বইয়ের প্রত্যাশা ছিল, তা থেকেই গেল। যে আলোচনাগুলো খুঁজছিলাম তার দু’একটা উদাহরণ দিই। ইকুইটি বা সাম্য বলতে ঠিক কী বোঝায়? তা কি ফলাফলের অসাম্যের কথা বলে, যেমন আয়ের অসাম্য? না কি, উৎপাদনের বিভিন্ন উপাদানের অধিকারের অসাম্যের কথা বলে, যেমন ভৌত ও সামাজিক পরিকাঠামো, ন্যায়বিচারের অধিকার, বিভিন্ন আর্থিক পণ্যের অধিকার ইত্যাদি? সরকারি ব্যয়ের ভূমিকা কী? সরকার পরিষেবার বন্দোবস্ত করবে, এবং সরকার শুধুমাত্র টাকা জোগাবে এই দুই পরিস্থিতির ফারাক কী? বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি এবং কিছু বিশেষ তফসিলি অঞ্চলের জনজাতিদের জন্য সংরক্ষণে কি আদৌ কিছু লাভ হয়েছে? এই সব প্রশ্নের কোনওটিই এখানে ঠাঁই পায়নি।
প্রশাসন কী ভাবে কাজ করে, এবং ব্যর্থ হয়, সেই প্রসঙ্গটি আলোচনা করতে গিয়ে গুরচরণ একটি বিশেষ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন: ‘ফ্লেলিং স্টেট’, মানে চাবুক-মারা, দাপুটে রাষ্ট্র। শব্দটির জনক হার্ভার্ডের ল্যান্ট প্রিচেট প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা থেকে আলাদা করে প্রশাসনিক ব্যর্থতার উপর জোর দিতে গিয়ে তিনি এটি ব্যবহার করেছিলেন। গুরচরণ তাঁর বইয়ে যে সব উদাহরণ দিয়েছেন, সেগুলি এই ফ্লেলিং স্টেট-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অর্থাৎ সেগুলি প্রশাসনিক ব্যর্থতার উদাহরণ। কিন্তু তিনি আসলে যা বলতে চান কিন্তু বলে উঠতে পারেননি তা হল রাষ্ট্রের ভূমিকা। শক্তিশালী রাষ্ট্রের একটিই অর্থ যে রাষ্ট্রে আইনকানুন শুধু কাগজে-কলমে থেকে যায় না, রাষ্ট্র তা যথাবিধি প্রয়োগ করতে পারে। কাজেই, আমি যে বৃহত্তর আলোচনার কথা বলছি, তার মূল সুর হওয়া উচিত ভারতের মতো দেশে সরকারের ভূমিকা।
গুরচরণ দাসের বইটি পাঠকের মনে এই প্রশ্নগুলি জাগাতে পারে। কিন্তু বইটি কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দেয় না। এমনকী, প্রশ্নগুলি নিয়ে আলোচনাও করে না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.