লম্বাটে ঘর। হাত কয়েক অন্তর চৌখুপ্পি জানলার নীচে সার দিয়ে বিছানা। শতরঞ্চির উপরে রঙচটা চাদর। সলকু সোরেন হাইস্কুলের ছাত্রাবাস।
ঘরের এক কোণে সেই অগোছাল বিছানার উপরে বসে ঢ্যাঙাআম হাইস্কুলের নবম শ্রেণির নির্বোধ সোরেন বলে, “উয়ারা এখন আর অত রেগে কথা বলে না জানেন। মাঝে মাঝে স্কুল শেষে আসে। আমাদের কুলের আচারও খাওয়ায়। নুনে-কামরাঙা হাতে ধরিয়ে বলে, জঙ্গলমহলের জন্য একটু চিন্তাভাবনা কর্ বাবা!” আর, শাল-পল্লবে ছাওয়া সলকু সোরেন হাইস্কুলের শান্তনু টুডু শুনিয়ে দেয় সেই মন্ত্রের কথা--‘সানাম লেকান জাঁঙ্গে দারাম, দেব রাপুদা/ জঙ্গলমহল বয়হাঁ দেব বাঁচওয়া’। মানে, সব প্রতিরোধ ভাঙব রে/ জঙ্গলমহল বাঁচাব রে। বাংলায় নিজেই তর্জমা করে দেয় ছেলেটি। ষাট ওয়াটের ডুমো আলোর প্রায়ান্ধকার ঘরে দশম শ্রেণির ছাত্রের গলায় সেই মন্ত্র যেন বেমানান এক পরিবেশে কেকেআর-এর থিম সঙ!
তুমি আইপিএল দেখছ?
ছেলেটি বলে, “সে’টি কী স্যার? বিপিএল কার্ড কী জানি। কিন্তু ওটা তো...”
ঢ্যাঙাআম, ছেন্দাপাথর, কদমাগড় কিংবা আরও প্রত্যন্ত সলকু সোরেন হাইস্কুল। বৈশাখের কচিপাতার অর্জুন-সেগুনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা জঙ্গলমহলে আদিবাসী প্রধান স্কুলে এখনও অচেনা আইপিএল। পারদ চড়ার আগেই বেলাবেলি স্কুল ছুটির পর প্রায় অভিভাবকহীন আবাসিক ছাত্রেরা হুটোপুটি করে বিল্লি-ডাং (অনেকটা ডাংগুলির মতো) নিয়ে। আইপিএলের আঁচ নয়, তাদের কাছে বরং অনেক বেশি চেনা বিপিএল কার্ড, বাসুয়া চাল (মোটা চাল) আর হ্যাঁ, বনপার্টি! শান্তনু বা নির্বোধের ‘উয়াদের’ সঙ্গে আলাপ হয়েছে কদমাগড় হাইস্কুলের সাগিন মুর্মুরও। তবে দশম শ্রেণির ছেলেটি চোখ কুঁচকে জানায়, “ওনাদের সঙ্গে কী কথা হয়েছে বলা নিষেধ।” কিন্তু এ ব্যাপারে স্কুলের বিধি-নিষেধ নেই? |
সলকু সোরেন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সুখলাল হেমব্রম কিঞ্চিৎ স্বর নামিয়ে বলেন, “ওঁরা (মাওবাদী) যে ফের আনাগোনা শুরু করেছেন, সে কথা কানে এসেছে। তবে পাঁচিলহীন খোলা স্কুল চত্বর, কে কখন আসছে, কাকে কী বোঝাচ্ছে, সব কি নজরে রাখা সম্ভব?”
সুখলালবাবুর সুরেই সিপিএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্র বলেন, “হারানো জমি তৈরিতে ফের নেমে পড়েছে মাওবাদীরা। মাও-পন্থায় ফেরাতে স্কুলের ছেলেপুলেদের সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তাও বলছে বলে আমাদের কাছে নির্দিষ্ট খবর আছে।” বিষয়টা এড়িয়ে না গিয়ে মাওবাদীদের সংগঠিত হওয়ার খবর যে ‘কিছু কিছু মিলছে’ মেনে নিয়েছেন তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি অরূপ চক্রবর্তীও।
তাদের আনাগোনার খবর পৌঁছিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছেও। অ্যামনেস্টির সদস্য মেহা দীক্ষিত দীর্ঘ দিন ধরে মাওবাদীদের বালক-সেনা নিয়ে অনুসন্ধান করছেন। তাঁর দাবি, পাঁচটি রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে অন্তত তিন হাজার ছেলে-মেয়েকে তাদের ‘বাল-সেনা’য় নিয়োগ করেছে মাওবাদীরা। সেই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গও রয়েছে। বিষয়টি কপালে ভাঁজ ফেলেছে রাষ্ট্রসঙ্ঘেরও। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব বান-কি-মুন তাঁর বার্ষিক রিপোর্টে বিষয়টি উল্লেখ করে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে সতর্ক করেছেন। আর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক পদস্থ কর্তা কোনও রাখঢাক না রেখে বলছেন, “মাওবাদীদের লক্ষ্য, চলতি বছরেই ওই রাজ্যগুলির সতেরোটা জেলা থেকে অন্তত ১০ হাজার বালক-সেনা জোগাড় করা।”
বালক-সেনা তৈরির আঁতুর ঘরগুলির নাম রাজ্য ভেদে আলাদা। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, কোথাও তা ‘বালক সঙ্ঘ’ কোথাও বা ‘বাল মণ্ডল’ কিংবা ‘শিশু সঙ্ঘ।’ যেখানে তাদের হাতেখড়ি হয় ‘গোয়েন্দাগিরি’র সঙ্গে। গ্রামে যুবকেরা কী আলোচনা করছে, মাওবাদী অ্যাকশন স্কোয়াডের কীর্তিকলাপের পরে গ্রামবাসীদেরর প্রতিক্রিয়া কী, এমনকী বাড়ির লোকেরাও সে ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করছেন, তা মন দিয়ে শোনা। তারপর তা বনপার্টির লোকেদের জানানো। বস্তুত, মাওবাদী এবং তাদের ‘কাজকর্ম’ সম্পর্কে লোকের মনোভাবটা বুঝতেই তারা ওই বালক-বালিকাদের মোতায়েন করে। আর তাদের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, ঠিকঠাক খবর দিতে পারলে অস্ত্র শিক্ষার রোমাঞ্চকর ‘গাজর।’ তারপর? গোয়েন্দাদের খবর, প্রাথমিক ঝাড়াই বাছাইয়ের পরে যারা কিঞ্চিৎ শক্তপোক্ত তাদের পাঠানো হয় অস্ত্র প্রশিক্ষণে। বাকিরা যায় জননাট্য মঞ্চে। যার লক্ষ্য, পথ-নাটক করে তাদের আদর্শ প্রচার করা।
শালবনির সুশীল হাঁসদা কিংবা সারেঙ্গার সুশীল হেমব্রম সেই ‘বালক সঙ্ঘের’ই পরিণত ‘ফসল’।
শালবনিতে নিজের স্কুল-বারান্দায় এক কিশোরের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলেন শিক্ষক কার্তিক মাহাতো। ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বররের ওই ঘটনার মূল অভিযুক্ত স্কুলেরই পুরনো ছাত্র সুশীল হাঁসদা। ষষ্ঠ শ্রেণির পরে স্কুল-ছুট সুশীল যোগ দিয়েছিল বনপার্টি-তে। গ্রেফতারের পরে সে নির্বিকার গলায় জানিয়েছিল, ‘কার্তিক স্যার’কে গুলিটা সেই করেছিল। তার সহপাঠীরা জানিয়েছিল, স্কুলে পড়ার সময়ে প্রায়ই সুশীলকে টিপ্পনি কাটতেন কার্তিকবাবু। সেই থেকে ‘স্যারের’ উপরে তার রাগ।
আর, সুশীল হেমব্রম, ২০১০-এর ফেব্রুয়ারি মাসে বাঁকুড়ার সারেঙ্গা থানার ওসি রবিলোচন মৈত্র খুনের অন্যতম অভিযুক্ত। বয়স সাকুল্যে ষোলো। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই তার স্কুল জীবনে দাঁড়ি পড়ে যায়। গোয়েন্দাগিরিতে হাত পাকানোর পরে ঝাড়খণ্ডে অস্ত্র প্রশিক্ষণ পায় সে। থানার ওসি-খুনের ওই ‘অপারেশন’-এর পরিকল্পনায় নিজেই সামিল হয়েছিল সুশীল। কেন? পুলিশের জেরায় সুশীল বলে, “সদ্য অস্ত্র চালানো শিখেছিলাম। ওই ডাকাবুকো ওসিকে খুন করতে পারলে দলে বিশেষ কদর হবে জানতাম। তাই....।”এ ব্যাপারে এক গোয়েন্দা কর্তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিশ্ব জুড়ে সন্ত্রাসবাদে বালক-সেনা ব্যবহারে যুদ্ধ বিশারদ অ্যান্ড্রুজ সিমন্সের ব্যাখ্যাটা: সাধারণ মানুষের কাছে উর্দিধারীরা বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা অপরিণত বয়সে বিশেষ ‘রোমাঞ্চকর’ বিষয়।
তিন বছর আগে, শিলদায় ২৪ জন ইএফআর জওয়ানকে খুনের সেই ঘটনাতেও ধৃতদের অনেকেই ছিল নিতান্তই নাবালক। পুলিশি জেরায় তারাও একই সুরে স্বীকার করেছিল, উর্দিধারীদের সঙ্গে লড়াই করার ‘রোমাঞ্চ’ পেতেই মাওবাদীদের সঙ্গে জুটেছে তারা। পশ্চিম মেদিনীপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার মনোজ বর্মাও বলেন, “মাওবাদী আদর্শ-টাদর্শ নয়, ছেলেগুলি স্বীকার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বিজয় কুমার বলেন, “বছর কয়েক আগেও এই বালক সেনারা কিন্তু মূল বাহিনীর পিছনে থাকত। দল অপারেশন সেরে ফেরার সময়ে পুলিশি আক্রণ ঠেকাতে ‘কভার’ করত বালক সেনারা। এখন ‘স্ট্র্যাটেজি’ বদলে গিয়েছে। বালক সেনারাই এখন সমরে সবার আগে।” আর, পিছনে পড়ে থাকছে বিল্লিডাং খেলা তাদের অনন্ত শৈশব। |