কখনও দিনের বেলায় প্রকাশ্যে গুলি করে খুন, কখনও বাড়ি ফেরার পথে সাইকেল থেকে নামিয়ে যুবককে গুলি করে খুন, রাতের অন্ধকারে মন্দিরের তালা ভেঙে বড় রকমের চুরি আবার মাদকাসক্তকে গুলি করে খুনের চেষ্টা। সাম্প্রতিক কালে একের পর এক অপরাধে সন্ত্রস্ত উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ মহকুমার মানুষ। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা হওয়ায় এমনিতেই মহকুমায় অপরাধমূলক কাজকর্ম ঘটেই থাকে। কিন্তু গত কয়েক মাসে যে ভাবে খুন ডাকাতি, চুরি বেড়ে গিয়েছে তাতে বাসিন্দারা আতঙ্কিত। তাঁদের মতে, এতদিন ছোটখাটো অপরাধ দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন তাঁরা। কিন্তু সম্প্রতি মহকুমা জুড়ে যে ভাবে খুনের ঘটনা ঘটছে, ডাকাতি হচ্ছে, গরু পাচারকারীদের দাপট বেড়েছে তাতে তাঁরা আতঙ্কে রয়েছেন।
অপরাধ ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় এতদিন বনগাঁর সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ী সকলেই পুলিশকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। কিন্তু এ বার তাঁদের অভিযোগ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেও। তাঁদের বক্তব্য, রাজনৈতিক দলগুলিও এ ব্যাপারে তেমন হইচই করে না। পাঁচ-দশ বছর আগেও কোনও খুনের ঘটনা ঘটলে মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতেন। বিক্ষোভ, মিছিল থেকে পথ অবরোধ, প্রশাসনকে স্মারকলিপি বাদ যেত না কিছুই। যার ফলে পুলিশ-প্রশাসনও বেশ চাপে থাকত। কিন্তু সে সব এখন অদৃশ্য। কয়েক বছর আগেও রাজ্যে বিরোধী দল হিসাবে থাকার সময় এ সব নিয়ে আন্দোলনে নামতে দেখা যেত তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের। কিন্তু ক্ষমতায় এসে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা এ সব নিয়ে চুপ। দু’একজন নেতা স্রেফ ‘পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলব’ মন্ত্যব করেই ক্ষান্ত দেন। অন্যদিকে, আগের শাসক দল ও বর্তমানে বিরোধীর ভূমিকায় বামফ্রন্ট বিশেষত সিপিএমকেও এ সবের বিরুদ্ধে সে ভাবে মাঠে নামতে দেখা যায়নি। |
যদিও বিরোধী নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মাঝেমধ্যেই রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে আওয়াজ তোলেন। কিন্তু সেই আওয়াজে দলের নীচু তলার কর্মীদের সামিল হতে দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু কেন? বনগাঁয় যে ভাবে অপরাধ বেড়ে চলেছে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি সোচ্চার নয় কেন?
স্থানীয় বাসিন্দা ও সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য দুলাল মণ্ডলের বক্তব্য, “বনগাঁয় আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে এটা ঠিক। কিন্তু এ নিয়ে সোচ্চার হতে গেলে, সভা করতে গেলে মাইক বাঁধার অনুমতি দেয় না পুলিশ। ওরা বলে এখন মিটিং-মিছিল করবেন না। বোধহয় ওপরতলা থেকে বারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে পুলিশ অনুমতি না দিলেও এ বার আমরা পথে নামব।”
আর কী বলছে কংগ্রেস?
বনগাঁ শহর কংগ্রেস সভাপতি কৃষ্ণপদ চন্দ বলেন, “এখানে কংগ্রেস এখন নিজেদের ঘর গোছাতেই ব্যস্ত। তবে যে ভাবে এখানে অপরাধ বাড়ছে তাতে সাধারণ মানূুষের আশঙ্কা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। এখানে পুলিশ বা প্রশাসন বলে কিছু নেই।”
তবে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে যাঁরা সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদে মুখর তাঁরা স্থানীয় ব্যবসায়ী মহল। বনগাঁ চেম্বার অব কমার্স-এর সম্পাদক বিনয় সিংহ বলেন, “আগে রাতের অন্ধকারে খুনের ঘটনা ঘটত। কিন্তু দুষ্কৃতীরা এখন এতটাই বেপরোয়া যে দিনেও খুন করছে। আমরা চিন্তিত এবং আতঙ্কিতও বটে।” একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “বনগাঁ থানার আইসি চেষ্টা করছেন। কিন্তু তা যে দুষ্কৃতীদের দাপট কমাতে যথেষ্ট নয়, বার বার তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।”
তবে দুষ্কৃতীদের এতটা অবাধ বিচরণের নেপথ্যে উঠে এসেছে কিছু কারণও। অনেকের মতে, এলাকায় দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য সত্ত্বেও পুলিশকে তা জানাতে ভয় পান অনেকে। পাছে সেই খবর দুষ্কৃতীদের কানে পৌছে যায়। তা ছাড়া পুলিশি হেনস্থার আশঙ্কাও করেন কেউ কেউ। আবার আগে বিভিন্ন এলাকায় দুষ্কৃতীদের সম্পর্কে পুলিশকে যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করত তাদের নিজস্ব ‘সোর্স’। বর্তমানে তারাও অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। ফলে পুলিশের পক্ষেও দুষ্কৃতীদের সম্পর্কে তথ্য জানা সম্ভব হচ্ছে না। অপরাধ নির্ণয়, দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে। এর পাশপাশি অভিযোগ, সাম্প্রতিক সময়ে বনগাঁয় ভাড়াটে খুনির আনাগোনা বেড়েছে। বাংলাদেশ থেকেও আসছে দুষ্কৃতীরা। বেড়েছে অস্ত্রের সরবরাহও। দুষ্কৃতীদের কাছে সেভেনএম এম, নাইন এমএম-এর মতো আধুনিক অস্ত্রই শুধু নয়, মিলছে অত্যাধুনিক বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটও। কিছুদিন আগেই এক দুষ্কৃতীর কাছে ওই ধরনের জ্যাকেট উদ্ধার করে পুলিশ।
স্থানীয় বাসিন্দা এক প্রৌঢ়া বলেন, “বনগাঁ থানায় নতুন আইসি এলে প্রথম প্রথম তৎপরতা দেখা যায় পুলিশের। রাতের টহলদারি, গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি সবই নিয়মিত চলতে থাকে। কিন্তু বেশ কয়েক মাস গেলেই ফের যে কে সেই।
তবে পুলিশ যে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট তৎপর তা দাবি করে বনগাঁর এসডিপিও রূপান্তর সেনগুপ্ত বলেন, “পুলিশ নিষ্ক্রিয় এটা একেবারেই ঠিক নয়।” মহকুমাবাসীকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, “গত কয়েক মাসে অভিযান চালিয়ে পুলিশ প্রচুর বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করেছে। উদ্ধার হয়েছে ২৫টি আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি। ২৫ জন দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
বৃহস্পতিবার স্থানীয় একটি স্কুলের এক চতুর্থশ্রেণির কর্মীর খুনের ঘটনায় শুক্রবার বনগাঁয় আসেন ডিআইজি (প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ) দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, জেলার পুলিশ সুপার সুগত সেন। স্থানীয় বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস বলেন, “রাজনৈতিক রং না দেখে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিয়ে ডিআইজিকে অনুরোধ করেছি।” দিলীপবাবু বলেন, “বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি মহকুমায় অপরাধ দমনে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’
কিন্তু এ সব সত্ত্বেও কি আতঙ্ক কাটবে বনগাঁবাসীর? আগামী দিনেই তার উত্তর মিলবে। |