‘কে আমারে যেন এনেছে ডাকিয়া, এসেছি ভুলে
...সে দিন যে গেছে ভুলে গেছি, তাই এসেছি ভুলে।’
রবীন্দ্রনাথ ‘প্রেম’কে কী চোখে দেখতেন ‘ভুল’ কবিতায় তার একটা ছবি অনুভব করা যায়। কবি প্রত্যেক প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছেন আবার উত্তরণও দেখাচ্ছেন। এক দিকে মানুষের অন্তরাত্মার মুক্তিকামী প্রেম। অন্য দিকে বাহ্যিক রূপের বা বাস্তব প্রেমের প্রকাশকে প্রাধান্য না দেওয়া। বাহ্যিক রূপের অতীত যে ‘অরূপ’ প্রেম, তারই প্রকাশ দেখি কবির সৃষ্টিতে।
প্রেম বা তার অনুভব কেমন হতে পারে ‘রবিবার’ গল্পটির অংশবিশেষে অভীকের চিঠিতেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। ‘তুমি মনে মনে কখনো আমাকে ঈর্ষা করেছ কিনা জানি না। এ কথা সত্য, মেয়েদের আমি ভালবাসি। ঠিক ততটা না হোক, মেয়েদের আমার ভাল লাগে। তারা আমাকে ভালবেসেছে, সেই ভালবাসা আমাকে কৃতজ্ঞ করে। তুমি স্পষ্ট করে আমাকে তোমার ভালবাসা জানাওনি, কিন্তু তোমার স্তব্ধতার গভীর থেকে প্রতিক্ষণে যা তুমি দান করেছ, নাস্তিক তাকে কোনও সংজ্ঞা দিতে পারেনি বলেছে অলৌকিক।’
বহু দিন পরে রবীন্দ্রনাথের ‘অধরা’ প্রেমের আমেজ ফিরছে শ্রোতাদের কাছে। দারুণ বললেন এফ-এম এর পরিচিত কণ্ঠ রাজা, “সেই কোন ছোটবেলায় জগন্নাথ বসুর গলায় শুনেছিলাম রবিবারের অংশবিশেষ। সেই থেকেই আমি স্বপ্ন দেখতাম, এক দিন আমিও শ্রোতাদের শোনাব ‘রবিবার’-এর পাঠ। উপলব্ধি করেছি রবীন্দ্রনাথ আজও কতটা আধুনিক।” যেমন? বিভাকে ‘বী’ বলে ডাকতেন অভীক। ‘বী, আমার মধুকরী, জগতে সবচেয়ে ভালবেসেছি তোমাকে।’ অভীকের এই ভালবাসা যেন কোনও নাস্তিকের কাছে ঈশ্বর সাধনার নামান্তর। বিশ্বাস আর বুদ্ধির দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করে- সেই প্রেম শুধু সর্ব-সত্তা সমর্পণ করতে চায়। তাই অভীক বলে ‘...এতদিন বুঝতে চেয়েছিলুম বুদ্ধি দিয়ে, এবার পেতে চাই আমার সমস্তকে দিয়ে।’ প্রতিটি ছত্রে ফুটেছে অনুরাগ ও সমর্পণের সুন্দর মেলবন্ধন। কিন্তু এমন আবেগ কতটা ফুটিয়ে তুলতে পারবে রাজা? “দেখুন এই কাজটি জানি খুব কঠিন। চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি।” আত্মবিশ্বাসী তিনি।
এমনই শিহরণ গানেও। যখন রবীন্দ্রনাথের প্রেমের আকুতি পরিপূর্ণ হয় সেই গানেও। কিন্তু অনুভূতি? শ্রাবণী সেন বললেন, “এ যেন শুধু গান গাওয়ার জন্যই গান নয়। আবেগের সঙ্গে তাল মেলানো।” ‘আমার মন কেমন করে,’ ‘তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে’, ‘আমার সকল নিয়ে,’ ‘অবেলায় যদি এসেছো,’ প্রভৃতি গানে প্রেমের মান-অভিমান ওঠানামা করে। ‘কালের যাত্রা’ সিডি সংকলনে রাজা ও শ্রাবণীর মতোই নজর কেড়েছেন রাজা নারায়ণ দেব। যিনি আবহ ও সঙ্গীত ভাবনায় নতুনত্ব এনেছেন নিজস্ব চিন্তা-ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে। স্টিমার থেকে লেখা চিঠির আঙ্গিক ফুটেছে জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে। কখনও এক ঝাঁক সিগাল উড়ে যাওয়ার সেই চেনা আওয়াজ। কখনও বা চলন্ত ট্রেনের মৃদু কম্পন।
এই সংকলনটি নিয়ে রাজা ও শ্রাবণীর বিশ্বাস, “অধরা প্রেমেও রবীন্দ্রনাথ কতটা সচেতন ছিলেন তা নতুন করে এই প্রজন্মের কাছেও একটা কৌতূহল জাগাবে।” |