গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে মাটির পাত্রে জল ভরে রাখা হয়েছে। ওগুলো পাখিদের জন্য। গোটা গ্রীষ্মকাল পাত্রের সারি দেখা যাবে বীরভূমের প্রতিটি রেঞ্জ ও বিট অফিসের আশপাশে। ইতিমধ্যেই হাজার খানেক মাটির পাত্র জেলার আটটি রেঞ্জ আফিসে ও ২০টি বিট অফিসে বিলি করার জন্য পৌঁছেছে। সেই সঙ্গে, সিউড়ির চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ২০০ জন স্কুলপড়ুয়ার মধ্যেও বিলি করা হয়েছে ওই মাটির পাত্র। উদ্দেশ্য একটাই প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে অন্যতম অঙ্গ পাখিরা যেন গ্রীষ্মকালে জলের অভাবে মারা না যায়। সেই সচেতনতা ছোটদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া।
এই উদ্যোগ নিয়েছেন জেলা বনাধিকারিক কিশোর মাঁকড়। তিনি বলেন, “২০১০ সাল থেকেই লক্ষ্য করছি, আশেপাশের বেশ কিছু পাখি গ্রীষ্মকালে মরে যাচ্ছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে বুঝতে পারি, জলাভাবে মৃত্যু হয়েছে তাদের। সেই জন্যই এই ব্যবস্থা।” দুবরাজপুরের রেঞ্জ অফিসার কুদ্দুস হোসেন বলেন, “আমরা পাখির জন্য পাত্র ভরে রাখার নির্দেশ মেনে চলব।” কিন্তু কাজও তো বাড়ল। তা নিয়ে আক্ষেপ নেই কর্মীদের। দুবরাজপুরের দুই বনকর্মী জানালেন, সামান্য কাজ। পাখিগুলো তো বাঁচবে। |
বাসা বানাতে ব্যস্ত।—নিজস্ব চিত্র |
কিন্তু বহু পাখিই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তার কারণ নিয়ে এক দশক গবেষণা করছেন শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা কলাভবনের প্রাক্তন ছাত্র শুচিস্মিত ঘোষ। দিনভর বীরভূমের নানা প্রান্ত ঘুরে বেড়ান পাখির সন্ধানে। তিনি জানান, বাজ, সারস, শকুন ধুলো-চাটা পাখি থেকে বিভিন্ন পরিযায়ী পাখিও কমে যাচ্ছে। তাঁর ব্যাখ্যা, “শহরের নতুন বাড়িতে ঘুলঘুলি থাকছে না। গ্রামেও এখন একটু অবস্থাপন্ন মানুষ বাড়িতে খড়ের বদলে টিনের ছাউনি দিচ্ছেন। এর ফলেই চড়াই বাসা বাধার জায়গা পাচ্ছে না।” পরিবেশে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়াতেও তাদের প্রজনন হচ্ছে না। শুচিস্মিতবাবু আরও বলছেন, “চড়াইয়ের মতো দেখতে ধুলো-চাটা নামে এক প্রজাতির পাখিও বিলুপ্ত হতে বসেছে। ওরা বাসা বাধে সর্ষের জমির গর্তে। সষের্র ক্ষতিকারক পোকারা ওদের খাদ্য। কিন্তু জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করার ফলে খাদ্যে টান পড়ছে ওই প্রজাতির পাখির। ওই রকম আরও তিনটি প্রজাতির পাখি এই কারণে বিলুপ্ত হতে বসেছে।”
অন্য দিকে শহর ও গঞ্জের বড় বড় গাছ কেটে ফেলায় বাজ, সারস, শকুন প্রভৃতি প্রজাতির পাখিরাও আস্তানা হারাচ্ছে বলে মনে করছেন শুচিস্মিতবাবু। এ দিকে, বিলুপ্তির দিকে চলে যাওয়া শকুন নিয়ে শুচিস্মিতবাবুর ব্যাখ্যা, অসুস্থ গবাদি পশুকে এক ধরনের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। সেই সব গবাদি পশু মারা গেলে তাদের মাংস খেয়ে শকুনও মারা যাচ্ছে। আবার জলাশয় বুজিয়ে ফেলার জন্যও অনেক প্রজাতির পাখি হারিয়ে যেতে বসছে।
বনাধিকারিক থেকে গবেষক, সবারই ভয়, এমন দিন যেন না আসে যখন মানুষকে বলতে হয়,
“যেখানে যা বই আছে পাখি সম্বন্ধে
সব বই পড়ে ফেলি সকাল সন্ধে
আজ পড়া শেষ হবে, একটাও বাকি নেই
আফশোস শুধু এই তল্লাটে পাখি নেই।”
এডওয়ার্ড লিয়র (অনুবাদক সত্যজিৎ রায়) |