পরীক্ষায় টুকিতে দিবার অধিকার লইয়া মুলায়ম সিংহ যাদবের উত্তরপ্রদেশ একদা বিস্তর দুর্নাম কিনিয়াছিল। এই অধিকারের অনুশীলনে পশ্চিমবঙ্গও কিন্তু দ্রুত অগ্রসর হইতেছে। গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকের দুর্নাম ঘুচাইয়া অন্তত পরীক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলারক্ষার যে ঐতিহ্য এই রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, পরিবর্তন-এর হাওয়ায় তাহা অন্তর্হিত। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় গণটোকাটুকির দৃশ্য ইতিপূর্বে গণমাধ্যমে সবিস্তার প্রচারিত। এখন শুনা যাইতেছে, কলেজের পরীক্ষাতেও সেই ধারা আমদানি হইয়াছে। গণমাধ্যমে তাহার সচিত্র বিবরণী প্রকাশিত হইতেছে না, কারণ পরীক্ষাকেন্দ্রে কর্তব্যরত তত্ত্বাবধায়কদের হুমকি দিয়া পরীক্ষার্থীরা এই অপকর্মে লিপ্ত হইতেছে। বাধা দিলে ‘দেখিয়া লওয়ার’ হুমকি, প্রাণনাশের হুমকি, ‘বাড়াবাড়ি না-করার’ হুমকি বর্ষিত হইতেছে। ইউনিয়নের নেতাদের পরীক্ষা দেওয়ার সময় যাহাতে বেশি কড়াকড়ি করা না হয়, সেই মর্মে কলেজের অধ্যক্ষরা পর্যন্ত আর্জি জানাইতেছেন। ইহার পর ইনভিজিলেটররা কেন আর বাধা দিতে যাইবেন, কেনই বা অভিযোগ দায়ের করিতে যাইবেন?
যেহেতু লিখিত অভিযোগ নাই, অতএব ‘না জানিতে’ অসুবিধা নাই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘২০১৩ সালের বি এ, বি এসসি ও বি কম-এর পরীক্ষা নির্বিঘ্নে, শান্তিতে ও সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হইয়াছে এবং কোথাও কোনও অনিয়মের অভিযোগ জমা পড়ে নাই’ জানাইয়া নিশ্চিন্ত। বাস্তব অভিজ্ঞতা ইহার বিপরীত। গত দুই বছর ধরিয়াই একের পর এক কলেজে ইউনিয়ন নির্বাচন ও দখলের নামে ছাত্রদের তাণ্ডব, অধ্যাপক-অধ্যক্ষদের অপমানিত, এমনকী প্রহৃত হওয়ার নজির, প্রভাবশালী রাজনীতিকদের আস্তিন গোটানো আস্ফালন ও প্ররোচনা এবং প্রতিপত্তিমান ছাত্রনেতাদের তাণ্ডবের প্রতি পুলিশের ক্ষমাসুন্দর, সস্নেহ প্রশ্রয়, জামিনযোগ্য ধারায় তাহাদের গ্রেফতার করার পরমুহূর্তেই ছাড়া-পাওয়া ছাত্রনেতাদের কলেজে প্রত্যাবর্তন। যাহা খুশি করিয়া পার পাওয়া যায়, এই বিশ্বাস ছাত্রদলের মনে গাঁথিয়া যাইতেছে। ফলে শিক্ষক-অধ্যাপক, পরীক্ষক, তত্ত্বাবধায়করা সন্ত্রস্ত দিন কাটাইতেছেন।
সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শিক্ষার অঙ্গনেও ষাট-সত্তরের দশকের নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাসের আগমনী শোনা যাইতেছে। একটা সময় ছিল, যখন পরীক্ষার হলে টেবিলের উপর প্রকাশ্যে ছুরি গাঁথিয়া পরীক্ষার্থীরা নজরদারদের সন্ত্রস্ত ও নিরস্ত করিত। বঙ্গীয় সমাজের যৌথ স্মৃতিতে বিলক্ষণ রহিয়াছে। যখনই টোকাটুকিতে লিপ্ত পরীক্ষার্থীরা ‘বাড়াবাড়ি’ না করার হুঁশিয়ারি দিতেছে, তখনই পত্রপাঠ স্মৃতিপটে সেই অরাজকতার ছবি ভাসিয়া উঠিতেছে। বামফ্রন্ট আমলে স্বাস্থ্যের মতোই শিক্ষাক্ষেত্রেও যে অবনমন ঘটে, তাহার মূলে ছিল দলীয় নিয়ন্ত্রণ ও স্বজনপোষণ। সে সবই রঙ পাল্টাইয়া অব্যাহত, উপরন্তু ফিরিয়া আসিয়াছে অরাজকতা, গুণ্ডামি, বাহুবলীদের রাজ। টুকিয়া পাশ করা অযোগ্যদের লইয়া যে মানবসম্পদ রাজ্য সঞ্চয় করিতেছে, তাহার সাহায্যে কোনও কৃতিত্বের শিখর স্পর্শ করা সম্ভব নয়। |