সম্পাদকীয় ১...
নাবালকের কূটনীতি
লাহৌরের কারাগারে সর্বজিৎ সিংহের মর্মান্তিক পরিণতি মনমোহন সিংহ এবং তাঁহার সরকারের বহুমাত্রিক সঙ্কটে আরও একটি মাত্রা যোগ করিয়াছে। লাদাখে চিনা সেনাবাহিনীর ‘অনুপ্রবেশ’-এর উপর্যুপরি সর্বজিৎ সিংহ কাণ্ড বিপদ যখন আসে, সত্যই একা আসে না! কেন্দ্রীয় সরকার আত্মপক্ষ সমর্থনের নানা চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু বিশেষ লাভ হইতেছে বলিয়া মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রীর তীব্র প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা সর্বব্যাপী নিন্দার প্লাবনে বেমালুম ভাসিয়া গিয়াছে। এই নিন্দা কি সঙ্গত? প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁহার প্রশাসন যথেষ্ট ‘কঠোর’ হইলে কি সর্বজিৎ সিংহের কাহিনির এই পরিণতি এড়ানো সম্ভব হইত? তেমনটি ভাবিতে ভাল লাগে, কিন্তু বাস্তব অনেক বেশি কঠিন। ভারত এবং পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্কের বাস্তব এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাস্তব, দুইই অত্যন্ত জটিল। ইসলামাবাদের উপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করিয়া মৃত্যুদণ্ডিত কয়েদিকে মুক্ত করিয়া আনা বা তাঁহার প্রাণদণ্ড রদ করার সামর্থ্য দিল্লির আয়ত্ত নহে। সর্বজিৎ সিংহের বিচারপ্রক্রিয়া যথাযথ হইয়াছে কি না, সেই তর্ক এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। ভারতের বিচারপ্রক্রিয়াও সমস্ত ক্ষেত্রে প্রশ্নাতীত, এমন দাবি করা চলে না। আফজল গুরু স্মরণীয়।
অভাব কঠোরতার নয়, অভাব পরিণত কূটনীতির। পাকিস্তান সরকারের অভিযোগ, সর্বজিৎ সিংহ সন্ত্রাসবাদী এবং গুপ্তচর। এই অভিযোগ সত্য হইতে পারে, না-ও হইতে পারে। বস্তুত, যে সন্ত্রাসের ঘটনাটির দায়ে তাঁহাকে দায়ী করা হইয়াছিল, তাহার সহিত সর্বজিতের যোগাযোগ না থাকিবার সম্ভাবনাই প্রবল। কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ যে অহেতুক নয়, এমন সংশয় অনেকেই প্রকাশ করিয়াছেন (বা অপ্রকাশ রাখিয়াছেন) এবং ঘটনাপরম্পরা ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিচার করিলে সেই সংশয়কে সম্পূর্ণ অহেতুক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া কঠিন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশ্ন ওঠে, ভারতীয় কূটনীতি কি এই ধরনের সমস্যার মোকাবিলায় যথেষ্ট দক্ষ? বিশেষত পাকিস্তানের সহিত সম্পর্কের ক্ষেত্রে? গুপ্তচরবৃত্তি নূতন নহে, কৌটিল্য স্মরণীয়। আধুনিক যুগেও যে তাহা অন্তর্হিত হয় নাই, তাহার বহু প্রমাণ অহরহ মিলিয়া থাকে। ভারত-পাকিস্তান কূটনীতিও ইহার ব্যতিক্রম বলিয়া ধরিয়া লইবার কারণ নাই। অতীতেও উভয় পক্ষ হইতেই অন্যের বিরুদ্ধে গুপ্তচর ব্যবহারের অভিযোগ উঠিয়াছে, ভবিষ্যতেও উঠিবে বলিয়াই অনুমান, অন্তত তেমন অনুমানই বাস্তববুদ্ধির পরিচায়ক। দুই প্রতিবেশীর পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সুসম্পর্কের অভাব থাকিলে গুপ্তচরবৃত্তির জন্মভূমি উর্বর হয়। সর্বজিৎ সিংহ গুপ্তচর হউন বা না হউন, এক দেশের গুপ্তচর অন্য দেশে ধরা পড়িবার সম্ভাবনা সর্বদাই থাকিয়া যাইবে। কী ভাবে সেই পরিস্থিতি সামলানো হইবে, প্রশ্ন ইহাই।
উত্তর মিলিতে পারে ইতিহাসের পৃষ্ঠায়। ঠান্ডা লড়াইয়ের ইতিহাস। সেই যুগে দুই মহাশক্তি পরস্পরের উপর নজরদারির উদ্দেশে নানাবিধ গোপন কৌশল ব্যবহার করিত, গুপ্তচর সহ। অনুমান করা যায়, মাঝে মধ্যে তাহা লইয়া সমস্যাও ঘটিত। কিন্তু সচরাচর সেই সমস্যা দুই তরফের পারস্পরিক বোঝাপড়ার পথেই মিটাইয়া লওয়া হইত, কাকপক্ষী টের পাইত না। কালেভদ্রে জানাজানি হইলেও সঙ্কটের নিরসন ঘটিত পরিণত দক্ষতায়। যেমন ১৯৬০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে ধৃত মার্কিন ‘গুপ্তচর’ ফ্রান্সিস গ্যারি পাওয়ার্সকে লইয়া রুশ নায়ক নিকিতা ক্রুশ্চেভ স্বভাবসিদ্ধ আড়ম্বরে অনেক শোরগোল তুলিয়াছিলেন বটে, কিন্তু শেষ অবধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিন বছর আগে ধৃত সোভিয়েত ইউনিয়নের রুডল্ফ আবেল-এর বিনিময়ে তাঁহাকে মুক্ত করিয়া লওয়া হয়। ইহার নাম সাবালকের কূটনীতি। ভারত ও পাকিস্তান যদি সাবালক হইতে চাহে, তবে তাহাকে সেই কূটনীতি শিখিতে হইবে। সেই শিক্ষা হয় নাই। কোনও জমানাতেই হয় নাই। শিক্ষার প্রয়োজন যে আছে, তাহাও এ-দল, ও-দল, সে-দলের কেহই মনে করিয়াছেন কি? করিলে হয়তো আজ সর্বজিৎ সিংহের এই পরিণতি হইত না, মনমোহন সিংহকে নিষ্ফল ও অসহায় ক্ষোভ প্রকাশ করিতে হইত না, নরেন্দ্র মোদীদেরও ‘কঠোরতা’র মুষ্টিবদ্ধ দাবিতে জনমনোরঞ্জক এবং অন্তঃসারশূন্য গর্জন করিয়া দেশপ্রেমিক সাজিবার প্রয়োজন হইত না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.