অস্পষ্টতা ও বিতর্ক নিয়েই বিধানসভায় বিল পাশ
স্পষ্টতা সংক্রান্ত প্রশ্নের কোনও নির্দিষ্ট জবাব ছাড়াই বিধানসভায় পাশ হয়ে গেল বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার দৌরাত্ম্য ঠেকানোর লক্ষ্যে নতুন বিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন এবং সেখানে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষায় এই বিল পাশ ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনা। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস, বিলটি যাতে দ্রুত রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়, সে জন্য তাঁরা বিশেষ তৎপর হবেন।
বিরোধীরা বিলকে সমর্থন করা সত্ত্বেও গোটা পর্বটি কিন্তু জটিলতামুক্ত হল না। বিলটি যাতে আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে না-পড়ে, তার জন্য কংগ্রেস ও বামেদেরর তরফে কয়েকটি সংশোধনী আনা হয়েছিল। সেগুলির কোনটিও গৃহীত না হওয়ায় প্রতিবাদে কক্ষত্যাগ করেন কংগ্রেস বিধায়করা। অধিবেশনের শেষে ধন্যবাদজ্ঞাপন-পর্বে মুখ্যমন্ত্রী বাম আমলের অনেক ফাইল নিখোঁজ বলে অভিযোগ করতে থাকায় ক্ষুব্ধ বাম বিধায়করাও সভা ছেড়ে যান। তবে তার আগে বাম-কংগ্রেস, দুই শিবিরই সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের দাবি বিধানসভায় নথিভুক্ত করিয়েছে। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বা মুখ্যমন্ত্রী কেউই এই দাবির জবাব দেননি।
ভারতীয় দণ্ডবিধি এবং ফৌজদারি দণ্ডবিধিতেই যা করা যায়, তা নিয়ে আবার নতুন বিল আনার অর্থ কী এই প্রশ্ন তুলতে গিয়ে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মঙ্গলবার দাবি করেন, “এই কেলেঙ্কারিতে অনেক বড়-বড় লোক জড়িত। আধ ডজন মন্ত্রী, সাংসদের নাম আসছে। এই তদন্ত সিবিআই ছাড়া কেউ করতে পারে না। কিন্তু সিবিআই আবার রাজনৈতিক চাপের কাছে নমনীয়। তাই নজরদারি চাই আদালতের। সুপ্রিম কোর্ট হলেই ভাল হয়। সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকুক। বিলের সঙ্গে এর তো কোনও সম্পর্ক নেই। যদি মনে করেন প্রাক্তন শাসক অর্থাৎ বর্তমান বিরোধীরা এতে জড়িত, তা হলে নিরপেক্ষ তদন্ত করুন।” একই ভাবে কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়ার যুক্তি, “সিবিআইয়ের হাতে তদন্তের ভার তুলে দেওয়ার মতো আদর্শ মামলা এটি। এতগুলো রাজ্যে সংস্থাটির (সারদা) কারবার ছড়িয়ে আছে। রাজ্য সরকার যা করছে, করুক। কিন্তু শুনছি তারা নিজেরা কোনও মামলা করেনি! এটা কি সত্যি?”
অধিবেশনের প্রথমে প্রস্তাব এনে ২০০৯ সালে পাশ হওয়া বিলটি প্রত্যাহার করে নেন পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থবাবু। কেন ওই বিল প্রত্যাহার করা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি এই বিষয়ে কী বার্তা দিয়েছেন এই প্রশ্নের কোনও সুনির্দিষ্ট জবাব পাননি বিরোধীরা। তাঁরা দাবি করেন, আগের বিলটিই সংশোধন করে পাশ করালেই সময় বাঁচত। নতুন বিল পাশের পর মুখ্যমন্ত্রীও অবশ্য বলেন, “আমার সাধারণ বুদ্ধিতে যতটা বুঝি, একটা বিল পড়ে থাকলে একই বিষয়ে আর একটা বিল আনা যায় না।”
বিতর্কে অংশ নিয়ে কংগ্রেস ও বাম বিধায়করা একের পর এক প্রশ্ন তোলেন নতুন বিলের যৌক্তিকতা এবং বিভিন্ন ধারা নিয়ে। মানসবাবু সওয়াল করেন, বিলে উল্লিখিত ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’-এর সম্মতি ছাড়া এই ধরনের মামলায় কোনও আদালতে যাওয়া যাবে না এমন ব্যবস্থা সাংবিধানিক অধিকারের বিরোধী। বিলের ২২(২) ধারায় যে ভাবে অতীতের ঘটনার বিচারের কথা বলা আছে, তা-ও সংবিধান এবং ফৌজদারি দণ্ডবিধিকে লঙ্ঘন করছে। মানসবাবু দাবি করেন, “বিধানসভায় অ্যাডভোকেট জেনারেলকে ডেকে এ সব প্রশ্নের ব্যাখ্যা নেওয়া হোক। এত গুরুত্বপূর্ণ বিল, তাতে এত ফাঁক থাকা উচিত নয়। যাতে সিঙ্গুর বিলের মতো (আদালতে) আটকে না যায়!” মানসবাবুর দাবি খারিজ করে দেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়।
পুরনো ও নতুন বিলের ধারা ধরে ধরে দু’টোর মধ্যে সাদৃশ্য দেখিয়ে সূর্যবাবুও বেশ কিছু অস্পষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এই ধরনের অপরাধের বিচারের জন্য ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’ কে বা কারা হবেন, বিলে কেন তার কোনও স্পষ্ট ব্যাখা নেই, জানতে চান তিনি। এই সূত্রেই সরকারের প্রতি বিরোধী দলনেতার আর্জি, “এমন কিছু করবেন না, যাতে সংশোধন করার জন্য আবার এই বিধানসভাতেই ফিরে আসতে হয়!” পরে সভার বাইরে তাঁর কটাক্ষ, “দক্ষতা না থাকলে বেশি দ্রুত গাড়ি চালাতে গেলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়।”
অর্থমন্ত্রী অমিতবাবু এ দিন জবাবি বক্তৃতায় বিশেষ একটা জবাবের মধ্যে যাননি। নতুন বিলের বিভিন্ন অংশ পড়ে দিয়ে তিনি দাবি করেন, আগের দু’বারের বিল এমন শক্তিশালী ছিল না। তাঁর বক্তব্য, “এক একটা ধারা ধরে ধরে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছি। সম্পত্তি আটক, বাজেয়াপ্ত, হাতবদল ঠেকানো সবই এই বিলে আছে। যা করেছি, স্বচ্ছ, স্পষ্ট এবং সরাসরি। কোনও মারপ্যাঁচের মধ্যে আমরা যাইনি!” আর পার্থবাবু বিল-বিতর্কে তাঁর বক্তৃতা জুড়ে বাম জমানাকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন।
বিধানসভার বাইরেও বামেরা এই বিল নিয়ে তৃণমূল সরকারকে আক্রমণ করছে। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি এ দিন দিল্লিতে অভিযোগ করেন, নতুন বিল এনে অর্থলগ্নি সংস্থাগুলিকেই সুবিধা করে দিচ্ছে মমতা সরকার। তাঁর যুক্তি, বামফ্রন্ট আমলের বিলে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন আদায়ের চেষ্টা না করে রাজ্য সরকার যে নতুন বিল আনল, তা আইন হিসাবে কার্যকর হতে অনেক সময় লাগবে। সেই সময়কে কাজে লাগাবে সারদা বা অন্য সংস্থা। ইয়েচুরির কথায়, “এটা আসলে সময় কেনার চেষ্টা। তৃণমূল সরকার চিট ফান্ড মালিকদেরই বাঁচাতে চাইছে!”
বিল নিয়ে অস্পষ্টতা ও বিতর্কের মধ্যেই এ দিন বিধানসভায় ঢুকে পড়ে সারদা-যোগের প্রসঙ্গ। বিরোধী দলনেতা অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রশ্ন তোলেন, ২০১২ লাস ভেগাসে উত্তর আমেরিকা বঙ্গ সম্মেলনে তিনি ছুটি নিয়ে গিয়েছিলেন কি না। সেই অনুষ্ঠানের মুখ্য স্পনসর ছিল সারদা-গোষ্ঠী। খরচ হয়েছিল ২ কোটি টাকা। অমিতবাবুর সফরের খরচ কে বহন করেছিল? সূর্যবাবুর বক্তব্য ছিল, “আপনার জবাব না পেয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না।” অর্থমন্ত্রী পরে জবাব দেন, ওই অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাঙালিদের সামনে নতুন রাজ্য সরকারের কাজকর্ম তুলে ধরতেই তিনি লাস ভেগাস গিয়েছিলেন। সেই সঙ্গেই অমিতবাবু বলেন, “জেনে রাখুন, আমার সফরের সব খরচ রাজ্য সরকারই দিয়েছে। ওখানে পৌঁছে কিছু সময় আমি নিজের পকেটের পয়সাও খরচ করেছি। আমাকে ভদ্রলোক না বলতে পারেন। সেটা আপনার অধিকার। কিন্তু আমার দায়বদ্ধতা, সততা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুলতে দেব না!” অর্থমন্ত্রীর পিছনের আসনেই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর কথা শুনে তিনি দৃশ্যতই খুশি হন।
পরে বামেদের অস্বস্তিতে ফেলে অমিতবাবু পাল্টা বলেন, তাঁদের হাতে কিছু ছবি এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সারদাদের অনুষ্ঠানে ফিতে কাটছেন সিপিএমের প্রয়াত নেতা তথা প্রাক্তন মন্ত্রী। অমিতবাবু সরাসরি সুভাষ চক্রবর্তীর নাম না করে তাঁর ট্রেডমার্ক টুপির কথা বলে বুঝিয়ে দেন কার কথা বলছেন। পরে আবার সারদা-কর্তার হাত ধরে হেঁটে যেতেও দেখা যাচ্ছে তাঁকে। অমিতবাবুর জবাবের প্রতিক্রিয়ায় সূর্যবাবু আবার পরে সভার বাইরে বলেন, “অর্থমন্ত্রীর জবাব মুখের মতো হল না, সম্পূর্ণও হল না! অনুষ্ঠানের মুখ্য উদ্যোক্তা কে ছিল? এই প্রশ্নটার জবাব পেলাম না।”
আর সুভাষ-প্রশ্ন?
সূর্যবাবুর জবাব, “ওঁদের কাছে ছবি দেখতে চেয়েছি। তবে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যিনি আমাদের মধ্যে নেই, তাঁকে জড়িয়ে কিছু বলা ভাল রুচির পরিচয় নয়।”

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.