পছন্দের পেশা বাছার অধিকার না থাকলে সমাজের পারস্পরিক বিশ্বাসের স্তর ক্রমে নামতে থাকে।
শেষ পর্যন্ত উন্নয়নের ভিতটাই নড়ে যায়। রাজনীতির জালে জড়িয়ে থাকা পশ্চিমবঙ্গ কি সে পথেই চলেছে? |
আসুন, আজকের সকালটা একটু অন্য ভাবে শুরু করা যাক। আপনার বাড়িতে যে মহিলা ঠিকে কাজ করতে আসেন, তাঁকে ডাকুন। তাঁর পরিবার সম্বন্ধে কয়েকটা প্রশ্ন করুন। জানতে চান, তাঁর স্বামী কী করেন? বাবা কী করতেন? মা-ও কি ঠিকে ঝি-র কাজ করতেন/করেন? প্রতি মাসে মোট কত টাকা রোজগার করেন তিনি? কেন তাঁকে লোকের বাড়িতে ঠিকে কাজ করেই রোজগার করতে হয়?
দশ জনের মধ্যে ন’জনই যে উত্তরগুলো পাবেন, তা অনুমান করা যায়। আপনার কাজের মাসির বর রিকশা চালান, বা ঠিকে শ্রমিকের কাজ করেন। অনেকের বরেরই রোজগারের একটা বড় অংশ, সম্ভবত সবটাই, খরচ হয়ে যায় মদ-জুয়ার পিছনে। দু’মুঠো অন্ন সংস্থানের জন্য লোকের বাড়ির কাজ ধরতে হয় বউদের। সম্ভবত তাঁদের মায়েরাও লোকের বাড়িতেই কাজ করতেন, বা এখনও করেন কারণ তাঁদের সংসারের গল্পও একই রকম। সাত থেকে আটটা বাড়িতে কাজ করে মাসের শেষে রোজগার হয় পাঁচ হাজার টাকা।
কেন তাঁরা লোকের বাড়িতে ঠিকে ঝি-র কাজই করেন, জানতে চেয়ে উত্তরে একটা অবাক চাহনি পেয়েছেন বলেই অনুমান করছি। এই পেশা ছাড়া আর কিছু যে সম্ভব, এই মহিলাদের অধিকাংশই ভাবতে পারেন না। পারেন না অনেকগুলো কারণে।
এক) তাঁরা চারপাশে দেখেছেন, তাঁদের মতো মহিলারা লোকের বাড়িতে কাজই করেন;
দুই) অন্য কোনও চাকরির সুযোগ তাঁদের সামনে নেই;
তিন) যে চাকরি রয়েছে, তা করার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা তাঁদের নেই।
ফলে, সকাল পাঁচটা থেকে সন্ধে সাতটা পর্যন্ত আট বাড়িতে কাজ করে মাসের শেষে পাঁচ হাজার টাকা উপার্জনই তাঁদের একমাত্র পথ। সেই পথে কত অপমান রয়েছে, তাঁরা জানেন। আমরাও। |
প্রতিবেশী বাংলাদেশের মেয়েরাও ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই কাজে বেরিয়ে পড়েন। তাঁদেরও হাড়ভাঙা খাটুনি, তাঁদেরও উপার্জন খুব বেশি নয়। ফারাক হল, তাঁদেরটা বাড়ি-বাড়ি ঠিকে কাজ নয়। তাঁরা ‘গারমেন্টস’-এ কাজ করেন। সে দেশে যবে থেকে এই গারমেন্টস কারখানা আরম্ভ হয়েছে, ৩০ লক্ষেরও বেশি মেয়ে কাজ পেয়েছেন। তাঁরাও তেমন লেখাপড়া জানেন না। কিন্তু তাঁদের সামনে বিকল্প তৈরি হয়েছিল। আর, সেই বিকল্প বদলে দিয়েছে তাঁদের জীবন। সমাজ তাঁদের যে ভাবে দেখত, সেই ভঙ্গিটা বদলে গিয়েছে। বাড়ির বাইরে তাঁরা এখন অনেক জোরের সঙ্গে নিজেদের কথা বলতে পারেন, বাড়ির ভিতরেও। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও তাঁদের গলা শোনা যায়। একটা কারখানায় কাজ করার সুবাদে তাঁদের সামাজিক মেলামেশার গণ্ডিও ক্রমেই বড় হয়ে চলেছে। নতুন নতুন সুযোগের খবর তাঁদের কানে সহজে আসে।
আর সে দেশে যাঁরা শহরে থাকেন না, কারখানায় কাজের সুযোগ যাঁদের নেই, তাঁদের জীবনও গ্রামীণ ব্যাঙ্কের কল্যাণে কী ভাবে বদলে গিয়েছে, সে বিষয়ে ঢের কথা ইতিমধ্যেই হয়েছে। সেই প্রসঙ্গে আর ঢুকব না। একটা নতুন সুযোগ কী ভাবে জীবন বদলে দিতে পারে, এ পার বাংলার সঙ্গে ও পারের তুলনা করলে খুব স্পষ্ট হয়। এ পারে সেই সুযোগ পৌঁছবে কবে? কোন সীমান্ত পেরিয়ে?
মার্চের শেষ রবিবার লোকাল ট্রেনে চড়ে কোথাও গিয়েছিলেন? না গেলেও, পর দিন সব খবরের কাগজে যে ছবি বেরিয়েছিল, চোখে পড়েছিল নিশ্চয়ই। সে দিন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগের চাকরির পরীক্ষা ছিল। ৩৫,০০০ চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন কমপক্ষে ৪৫ লক্ষ মানুষ। তাঁদের অধিকাংশই কমপক্ষে স্নাতক, এবং স্বভাবতই প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার চেয়েও কম আকর্ষণীয় কোনও পেশায় আছেন, অথবা নিতান্ত বেকার। তাঁদের সিংহভাগই জানতেন, রবিবারের ট্রেনে জীবন পণ করে উঠে চৈত্রের রোদে ঘেমেনেয়ে পরীক্ষা দেওয়াই সম্ভবত সার হবে, শেষ পর্যন্ত চাকরি পাবেন না। তবু, তাঁরা মরিয়া ছিলেন পরীক্ষা দিতে। কারণ, সম্মানজনক জীবিকার আর কোনও পথ, এই পশ্চিমবঙ্গে, তাঁদের সামনে নেই। প্রাইমারি স্কুলের চাকরি তাঁদের সমাজের চোখে গ্রহণযোগ্য করবে, সম্মাননীয় করবে। বাংলাদেশে বস্ত্রশিল্প যেমন করেছে। ফারাক হল, সে দেশে বাজার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, আর এ পার বাংলায় আমরা, আমাদের রাজনীতি দিয়ে, সেই সুযোগের রাস্তা আটকে রেখেছি প্রাণপণ।
পশ্চিমবঙ্গ এখনও আটকে আছে ‘কৃষক আমাদের গৌরব, কৃষি আমাদের সম্পদ’-এর অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। যে সিঙ্গুরের জমিকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গ উথালপাথাল হয়ে গেল, সেখানে একটা সমীক্ষা করেছিলেন অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক। কারা শিল্পের জন্য জমি দিতে চান, অর্থাৎ পেশা বদলিয়ে কৃষি থেকে অন্য কিছু বেছে নিতে রাজি, আর কারা চান না বিস্তারিত খোঁজ করেছিলেন তাঁরা। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে (‘শিল্প নেই, তাই বিকল্প কম...’, ২৭/২ ও ‘জমির ব্যাপারে সরকারকে থাকতেই হয়’, ২৮/২) তিনি বলেছিলেন, তরুণ প্রজন্ম জমি বেচে দিতে অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশি ইচ্ছুক। অর্থাৎ, বিকল্প পেশা পেলে তাঁরা কৃষির মতো অ-লাভজনক পেশায় থাকতে চান না।
তবুও, তাঁরা কৃষিতেই আটকে পড়লেন। পড়বেনও। কারণ, বিকল্প পেশা তাঁদের সামনে নেই। যেটুকু আছে, সেই সুযোগ নেওয়ার মতো প্রশিক্ষণ তাঁদের নেই। রাজনীতির স্লোগান যতই তাঁদের জমির অধিকার রক্ষা করার কথা বলুক, সকালবেলা লোকের বাড়ি ঠিকে কাজ করতে যাওয়া মহিলাদের সঙ্গে এঁদের তফাত নেই দু’পক্ষের কারও শ্রমের বাজারে নাম লেখানোর স্বাধীনতা নেই। রাষ্ট্র তাদের সেই স্বাধীনতা অর্জন করতে দেয়নি। ইচ্ছেমতো পেশা বাছার স্বাধীনতা থাকলে তাঁদের কতখানি উন্নয়ন হত, সেই প্রশ্ন তো আছেই, অমর্ত্য সেন তাঁর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ফ্রিডম’-এ লিখেছেন, কাজের বাজারে যোগ দিতে পারার স্বাধীনতাটাই উন্নয়নের একটা মস্ত বড় ধাপ। ভোট দিতে পারার মতোই।
পছন্দের পেশা বাছতে পারার স্বাধীনতা না থাকলেই বা ক্ষতি কী? দুনিয়া জুড়ে চলা বিভিন্ন সমীক্ষার দেখা গিয়েছে, সম্মানজনক (এবং লাভজনক) পেশা বাছার স্বাধীনতা যত কমে, ততই সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাসের মাত্রা কমতে থাকে, আলগা হয়ে যেতে থাকে সামাজিক বন্ধন, কমতে থাকে সামাজিক প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা (সূত্র: ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট, ২০১৩)। সমাজে বিশ্বাস না থাকলে কী হয়, সিঙ্গুরের ১০০০ একর জানে। সেখানকার মানুষ বিশ্বাসই করতে পারেননি যে শিল্পের জন্য জমি দিলে তাঁদের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে না। তাঁরা কাউকে বিশ্বাস করেননি শাসক দলকে নয়, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে আসা প্রশাসনিক কর্তাদের নয়, জমি কিনতে চাওয়া শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নয়।
সেই অবিশ্বাস থেকে কী ভাবে জন্ম নিল এক আত্মঘাতী রাজনীতি, সে প্রশ্ন আপাতত থাকুক, কিন্তু অবিশ্বাসটাকে আলাদা ভাবে চিনে নেওয়া ভাল। তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেননি, কারণ আমাদের সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাসের স্তর খুব নীচে। আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষের এখনও সম্মানজনক ভাবে বেঁচে থাকার মতো জীবিকা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা নেই বলেই কি এই অবিশ্বাস? প্রশ্নটা ভাবার মতো। সামাজিক বিশ্বাসের মাত্রা বেশি হলে লাভ অনেক বাজার যেখানে অনিশ্চয়তার কারণে কাজ করতে পারে না, সেখানে বিশ্বাসের ভিত্তিতে কাজ এগিয়ে যেতে পারে; বিশ্বাস থাকলে দর কষাকষির খরচ কমে; আরও অনেক কিছু। প্রতিটাই উন্নয়নের জন্য অতি জরুরি। আজকের পশ্চিমবঙ্গে এই আলোচনা অলীক বলে মনে হয়।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে অবিশ্বাসের মাটিতে। মুখ্যমন্ত্রী পণ করেছেন, তিনি শিল্পের জন্য সূচ্যগ্র জমি অধিগ্রহণ করে দেবেন না। তাঁর এই পণের মূল কারণটি ভোটারের মন পাওয়া, তা নিয়ে সম্ভবত কারও সন্দেহ নেই। কিন্তু মন পাওয়ার পথটি তাৎপর্যপূর্ণ। বেসরকারি শিল্প এলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে অবিশ্বাসপ্রসূত এই ধারণাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তাঁর পণ। তিনি বলতে পারতেন, বেসরকারি শিল্পকে আসার ব্যবস্থা করে দেব, কিন্তু সেই শিল্পে যাতে স্থানীয় ছেলেমেয়েদের চাকরি হয়, তা-ও নিশ্চিত করব। তার জন্য তাদের লেখাপড়া শেখাব, পেশাদারি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব। তিনি বলেননি। এই রাজ্যের কোনও নেতাই বলেন না। কারণ, তাঁরা জানেন, রাজ্যব্যাপী অবিশ্বাসের চোরাবালিতে এই ইতিবাচক কথা ডুবে যেতে মুহূর্তমাত্র সময় লাগবে না। তাই পশ্চিমবঙ্গে নতুন সুযোগের দরজা-জানালা কষে বন্ধ করে রাখা।
এই লেখা প্রায় শেষ। আর এক বার কাজের মহিলাটিকে ডাকবেন? তাঁর ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তিনি কী ভাবছেন, জানতে চাইবেন এক বার? মহিলা আপনাকে সম্ভবত স্পষ্ট কোনও উত্তর দিতে পারবেন না। তিনি জানেন না। তাঁর চারপাশে যাঁদের তিনি সম্মানজনক কোনও কাজ করতে দেখেন যেমন আপনাদের তাঁরা ভিন্ গ্রহের মানুষ। তাঁর স্বজনের গণ্ডিতে সম্মানজনক পেশা পৌঁছয়নি। তাঁর ছেলেমেয়েরা, যারা হয়তো এখন স্কুলে যায়, তারাও জানে না ভবিষ্যতে কী করবে। বাড়ির পাশে শিল্প তৈরি হলে, মা-বাপকে সেই কারখানায় কাজ করতে যেতে দেখলে হয়তো জানত। হয়তো সেই কারখানার কোনও সহকর্মীর থেকে মা জেনে আসতেন আরও নতুন কোনও সুযোগের কথা, সন্তানের জন্য। কাজের অধিকার তো এ ভাবেই দুনিয়াটাকে বড় করে দেয়। বড় করে ভাবতে সাহস জোগায়।
আরও কত বছর অপেক্ষা করার পর শ্রমিক দিবস পশ্চিমবঙ্গে এই অধিকার নিয়ে আসবে? |