শৈবাল করের লেখা ‘কর্মসংস্কৃতি মাপা হবে কী করে’ (২৫-৪) পড়ে মনে হল কিছু কথা সংযোজন করা দরকার। আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে কর্মরত। দীঘর্র্ দশ বছর ধরে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তাতে মনে হয়, সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্কৃতি পরিমাপ করা বাস্তবিকই অসম্ভব। ‘কর্মসংস্কৃতি’ ছোট্ট কথা, তবে অর্থ অনেক গভীর।
শৈবালবাবু তাঁর নিবন্ধে কর্মসংস্কৃতি পরিমাপের যে সম্ভাব্য নির্ধারক বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন তার বাইরেও কয়েকটি বিষয় রয়েছে। যেমন, সরকারি অফিসে গিয়ে ন্যূনতম ভাল ব্যবহারটুকুও পাওয়া যায় না এই অভিযোগ বহু মানুষকে করতে শোনা যায়। সরকারি অফিস, পুরসভা কিংবা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা কাজে যাঁরা যাতায়াত করে, তাঁরা পরিষেবা পাওয়ার পাশাপাশি পরিষেবা প্রদানকারীদের তরফ থেকে একটু সুন্দর ব্যবহারও প্রত্যাশা করেন এবং দ্বিধা না-করে বলা যায় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা না-পেয়ে হতাশ হন। ভাল ব্যবহার প্রদান কি কর্মসংস্কৃতির অঙ্গ নয়? |
এখন অধিকাংশ সরকারি অফিসে প্রচুর পদ শূন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সময়ের নিয়ম মেনে কর্মীরা অবসর নিচ্ছেন কিন্তু সেই শূন্যস্থান দ্রুত পূরণ হচ্ছে না। ফলে, যাঁরা কর্মরত রয়েছেন তাঁদের উপর স্বাভাবিক ভাবেই কাজের চাপ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে নির্ধারিত কাজ যদি সঙ্গে সঙ্গে সেরে ফেলা না-যায়, তবে পরিষেবা প্রদান বিঘ্নিত হবেই। সরকারি অফিসের শূন্য পদে দ্রুত লোকনিয়োগে এক দিকে যেমন সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে, ঠিক তেমনই ‘ডু ইট নাউ’ স্লোগানকে বাস্তবায়িত করতে সরকারি অফিসের কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক হতে হবে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে। ব্যবস্থাপনারই এক শাখা ‘কর্মী-ব্যবস্থাপনা’য় ‘মেজর পাওয়ার প্ল্যানিং’ কথাটি খুবই প্রচলিত। ‘মনুষ্য শক্তি পরিকল্পনা’ বা ‘ম্যান পাওয়ার প্ল্যানিং’-এর অর্থ হল, কোন কাজে কত কর্মী দরকার তা কর্তৃপক্ষকে নির্ধারণ করতে হবে। ‘মনুষ্য শক্তি পরিকল্পনা’র বাস্তব প্রয়োগ সরকারি অফিসে প্রায় দেখাই যায় না। ফলে, একই সরকারি অফিসের কোনও কোনও দফতরে কর্মীরা কাজ পাচ্ছেন না। আবার অন্য দফতরে সামান্য সংখ্যক কর্মীর উপর পাহাড়প্রমাণ কাজের বোঝা চেপে থাকে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সঠিক ‘মনুষ্য শক্তি পরিকল্পনা’ কর্মসংস্কৃতিরই একটা অংশ।
সরকারি কর্মীর কাজ সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরটির ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল বা অনুজ্জ্বল করে। প্রতিটি কর্মীর কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টি বোঝানোর জন্য ট্রেনিং প্রোগ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। কর্মসংস্কৃতি ফেরানোর নামে হঠাৎ করে স্বল্প দিনের জন্য কর্তৃপক্ষ ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ হয়ে উঠলে চলবে না। কারণ, কর্মসংস্কৃতি আনা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কর্মসংস্কৃতিতে ছাপ ফেলে। কাজের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও মনোরম হলে কর্মীর কাজ করার উৎসাহ বাড়ে। অধিকাংশ সরকারি অফিস অপরিচ্ছন্ন, দীর্ঘ দিন রঙের প্রলেপ পড়ে না এবং সিঁড়ির দেওয়াল পান, গুটখার পিকে ভতির্র্। সরকারি অফিস পরিচ্ছন্ন রাখায় সরকার ও সাধারণ মানুষের সমান ভূমিকা আছে।
তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার কর্মসংস্কৃতি পরিমাপের একটি উপায়। কোন কর্মী সারা দিনে কতটা কাজ করলেন তা সহজেই কম্পিউটারের মাধ্যমে জানা সম্ভব। এখনও যে সমস্ত সরকারি ক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার আসেনি, সেই ক্ষেত্রগুলি কম্পিউটারাইজড করলে সরকারি প্রশাসনিক কাজকর্ম গতি পাবে। কর্মসংস্কৃতি পরিমাপের আসল চাবিকাঠিটা রয়েছে সরকারি কর্মীদের হাতেই। কী ভাবে কাজ করলে ‘পশ্চিমবঙ্গে সরকারি অফিসে কেউ কাজ করে না’ বদনাম ঘোচানো যাবে সরকারি কর্মীরা বিলক্ষণ জানেন। মনে রাখতে হবে, সরকারি পরিকাঠামোকে কাজে লাগিয়ে সরকারি দফতরে ‘প্রফেশনালিজম’ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বা সামাজিক বিপ্লব আনা সম্ভব।
সুদীপ চট্টোপাধ্যায়। হাওড়া-৬ |