টাকাপয়সা নিয়ে যারা কারবার করে, তেমন যে কোনও সংস্থা থেকে দূরে থাকার একটা মানসিকতা এখন
পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হতে পারে, ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাও যা থেকে রেহাই পাবে না। এটা খুবই চিন্তার কথা। |
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৈত্রীশ ঘটক |
পশ্চিমবঙ্গের অর্থলগ্নির বাজারে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ খুব বড় রকমের অনিশ্চয়তার শিকার হয়েছেন। অধিকাংশেরই সঞ্চয় অল্প, অনেকেই নিতান্ত দরিদ্র। এখন তাঁদের আর্থিক বিপর্যয় থেকে বাঁচানোর জন্য রাজ্য সরকার একটি ত্রাণ প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। এই উদ্যোগটি নিয়ে তর্ক উঠেছে। অর্থাভাবে যে সরকারকে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছাঁটাই করতে হয়, সে এ ধরনের উদ্যোগে টাকা খরচ করলে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। তবে কী ভারতে, কী অন্য দেশে, সরকার এ-রকম করেই থাকে। ব্যাঙ্ক বা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজেদের দোষে বিপাকে পড়লে সরকার তাদের পাশে দাঁড়ায়। বলা হয়ে থাকে, তারা ‘টু বিগ টু ফেল’ এত বড় প্রতিষ্ঠান লাটে উঠলে অর্থনীতিতে ভয়ানক প্রতিক্রিয়া হবে, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। এখন, যথেষ্ট বড় বলে কেউ সর্বনাশ করেও পার পেয়ে যাবে, আর অল্প টাকা জমিয়েছেন বলে বিপন্ন আমানতকারীদের কোনও গুরুত্ব নেই, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর দায় নেই এটা একটু অন্যায় কথা হল না কি? এটা ঠিকই যে, দুটো ভুল মিলে একটা ঠিক হয় না। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ক্ষতিপূরণের রীতি ইদানীং যে-রকম চলছে, তাতে এই ক্ষতিপূরণের উদ্যোগটির বিরুদ্ধে খুব কড়া অবস্থান নেওয়া বোধহয় উচিত নয়। |
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে স্বল্পসঞ্চয়ের হার অনেক বেশি, জনসংখ্যার অনুপাতেই দেখি অথবা মোট উৎপাদনের অনুপাতেই দেখি। ২০১১’র হিসেবে, পশ্চিমবঙ্গে দেশের মোট জনসংখ্যার ৭.৫ শতাংশের বাস, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জি ডি পি) বা কার্যত জাতীয় আয়ের ৬.৭ শতাংশ আসে এই রাজ্য থেকে। পাশাপাশি, পশ্চিমবঙ্গে ব্যাঙ্ক আমানতের অঙ্ক সারা দেশের ২২ শতাংশ। এহ বাহ্য। সম্প্রতি রাজ্যে একটি সমীক্ষায় প্রায় চল্লিশ শতাংশ মানুষ বলেছেন, ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলার মতো উপার্জন তাঁদের নেই মনে হয়, আমানতের অঙ্ক কম হলে ব্যাঙ্কগুলি সচরাচর পাত্তা দেয় না। আবার, যাঁদের ব্যাঙ্কে আমানত আছে, গত কয়েক বছরে তাঁরা দেখেছেন, চড়া মূল্যস্ফীতি তাঁদের সুদের টাকা বহুলাংশে খেয়ে নিয়েছে, অর্থাৎ প্রকৃত সুদের হার অনেক কমে গিয়েছে। স্বল্পসঞ্চয়কারীরা এমন কোথাও টাকা রাখতে চেয়েছেন যেখান থেকে ভাল আয় হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে মওকা পেয়ে অসাধু আর্থিক সংস্থাগুলি লোক ঠকানোর কারবার ফেঁদেছে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য সরকার কী করতে পারে। যে সব সংস্থা আমানত রাখে, তাদের উপর অত্যন্ত কঠোর নিয়ন্ত্রণ জারি করা অবশ্যই জরুরি। একটি সংস্থা যে নির্ভরযোগ্য, সেটা যথেষ্ট ভাল ভাবে যাচাই করে সুস্পষ্ট স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা দরকার, সেই স্বীকৃতি সম্পর্কে মানুষকে যথেষ্ট অবহিত করা দরকার, যাতে সবাই জানতে পারেন কাদের উপর ভরসা করা যায়। একই সঙ্গে, এটাও পরিষ্কার করে সবাইকে জানানো দরকার যে, যাদের প্রয়োজনীয় স্বীকৃতি নেই সেই সব সংস্থায় টাকা রেখে বিপদে পড়লে সরকার কোনও ক্ষতিপূরণ দেবে না। সেবি বা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতো কোনও অরাজনৈতিক এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে এই স্বীকৃতি দানের আয়োজনটিতে জড়িত রাখা উচিত, তারা যে জড়িত আছে সেটা জনসাধারণকে যথেষ্ট ভাল করে জানানো উচিত। অন্য দিকে, কী ভাবে স্বল্পসঞ্চয়কারীরা সহজে কার্যকর ব্যাঙ্কিং পরিষেবা ব্যবহার করতে পারেন, তার বন্দোবস্ত করতে হবে। এ জন্য মোবাইল ব্যাঙ্কিংয়ের মতো নতুন ধরনের উপায় কাজে লাগানোর কথা ভাবা যায়।
এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরির সময় আমাদের একটা কথা বিশেষ ভাবে মনে রাখা দরকার। ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে, পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, বেসরকারি ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলি অল্প আয়ের মানুষদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিয়ে-থা বা অন্যান্য অনুষ্ঠানের জন্যই হোক, গেরস্থালির সরঞ্জাম কিনতেই হোক অথবা ছোটখাটো ব্যবসার প্রয়োজনেই হোক, মানুষকে ধার করতে হয়। ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলি তুলনায় কম সুদে সেই ধার দিয়ে থাকেন। এটা স্বভাবতই তাঁদের খুব কাজে লাগে। যারা লোকের কাছ থেকে আমানত নিয়ে কারবার করে, এই ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলির সঙ্গে তাদের মৌলিক তফাত আছে। কিন্তু বিপদ হল, এখন পশ্চিমবঙ্গে টাকাপয়সা নিয়ে যারা কারবার করে তেমন যে কোনও সংস্থা থেকে দূরে থাকার একটা মানসিকতা তৈরি হতে পারে, ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাও যা থেকে রেহাই পাবে না। সেটা কিন্তু অন্যায়, অবাঞ্ছিতও। ক্ষুদ্র ঋণের কারবারিদের আমানত নেওয়া আইনত নিষিদ্ধ, সুতরাং আইনত তারা কোনও পন্জি স্কিম চালু করতেই পারে না। তারা অন্য ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে। যেমন অতিরিক্ত ঋণ দিয়ে ফেলে অনেকে বিপদে পড়ে, অনাদায়ী ঋণ শোধের জন্য বেআইনি ভাবে জবরদস্তি চালিয়ে সামাজিক সমস্যা ডেকে আনে। অন্ধ্রপ্রদেশে সাম্প্রতিক কালে এমন হয়েছে। কিন্তু এগুলো সম্পূর্ণ অন্য সমস্যা, সমাধানের পথও একেবারে অন্য রকম। বিশেষত, অতিরিক্ত ঋণ দিয়ে ফেললে ঋণদাতাদেরই লোকসান হয়, অনেক সময় তারা আসলটাও ফেরত পায় না। অন্ধ্রপ্রদেশের অভিজ্ঞতার পরে ক্ষুদ্র ঋণের কারবারিরা সবাই এখন অতিরিক্ত ঋণ দেওয়ার বিপদ সম্পর্কে সচেতন হয়ে গিয়েছেন, তাঁরা জানেন অতি লোভে ব্যবসা নষ্ট। তা ছাড়া, ক্ষুদ্র ঋণের কারবার নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতীয় স্তরে নতুন আইন চালু হয়েছে।
মোদ্দা কথা হল, ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার কাছে যে সব স্বল্প আয়ের মানুষ ধার করেন, অসাধু আমানতের কারবারিদের পাপের ফল যেন তাঁদের ভুগতে না হয়। সেটা হবে আনুষঙ্গিক ক্ষতি। যাকে বলে, ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’। একাধিক অর্থে।
অভিজিৎবাবু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’তে অর্থনীতির শিক্ষক;
মৈত্রীশবাবু ইংল্যান্ডে লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ অর্থনীতির শিক্ষক |