লাদাখ সীমান্তে চিনা গণমুক্তি ফৌজের ‘অনুপ্রবেশ’ এবং তাঁবু গাড়িয়া ফেলার সংবাদ লইয়া হইচই হইতেছে। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি তো বটেই, এমনকী ইউপিএ-র সমর্থক বলিয়া মান্য সমাজবাদী পার্টিও এই প্রশ্নে ভারত যথেষ্ট রণোন্মাদনা দেখাইতেছে না বলিয়া প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কঠোর সমালোচনা করিয়াছে। ভারতীয় বাহিনী কেন এখনই অনুপ্রবেশকারী চিনা ফৌজকে চ্যালেঞ্জ জানাইতেছে না, জানিতে চাহিয়া সরকারকে ‘দুর্বলচিত্ত’ ও ‘দ্বিধাগ্রস্ত’ বলিয়াও নিন্দা করা হইতেছে। বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছাড়াই এ ভাবে বিদেশনীতিকে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের অধীন করার চেষ্টা চলিতেছে। অথচ বাস্তব হইল, চিন-ভারত সীমান্তের রূপরেখাটি লইয়া কোনও দলীয় রাজনীতিকেরই বিশেষ ধারণা নাই। বিভিন্ন বৈঠকে পারস্পরিক ভিত্তিতে তাহা যে সকল শর্তসাপেক্ষে নির্ধারিত হইয়াছে, সেই সব বিস্তারিত তথ্য কাহারও কাছে সুলভ নহে। এখন যাহা ঘটিতেছে, তাহা সত্যই ‘অনুপ্রবেশ’ কি না, তাহা লইয়াও সন্দেহ আছে। দিল্লি ও বেজিং-এর ‘পন্থা’ বিষয়ে এত কম তথ্য লইয়া সেই ‘পন্থা’ লইয়া বিক্ষোভ-উত্তেজনা চিত্তাকর্ষক হইলেও কাজের কাজ নহে।
আগামী সপ্তাহে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদের চিন সফর এবং তাহার কিছু কাল পর চিনা প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের নির্ঘণ্টও ক্রমশ সমীপবর্তী হইতেছে। সদ্য-সদ্য তিন সদস্যের এক ভারতীয় সামরিক প্রতিনিধিদল তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত চিনা সামরিক সদর-দফতর চেংডু সফর করিয়াছে। সফরে দুই দেশের সৈন্যদের লইয়া যৌথ মহড়ার নির্ঘণ্ট স্থির হইয়াছে, যাহার লক্ষ্য সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী অভিযান। ব্রহ্মপুত্র নদের উপর তিনটি জলাধার নির্মাণের চিনা প্রস্তাব সম্পর্কে ভারতের উদ্বেগ লইয়াও দুই দেশের নদী-বিশেষজ্ঞরা আগামী সপ্তাহে বৈঠকে বসিতেছেন। এই সবের মধ্যেই সীমান্ত-বিরোধ লইয়া দুই দেশের আলোচনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই আলোচনার গোপনীয়তা এত যত্নসহকারে রক্ষিত যে তাহার সিদ্ধান্তসমূহ কোনও মতেই আমজনতার, এমনকী দলীয় রাজনীতিকদেরও অবগতির বিষয় নয়। চিনে সম্প্রতি নেতৃত্বের পরিবর্তন হইয়াছে। নূতন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সর্বদাই পুরানো পন্থা হইতে কিছুটা পৃথক হন। সলমন খুরশিদ সেই পার্থক্য মাপিয়া দেখিতে প্রতিবেশীসুলভ কূটনৈতিক সফরে চিন যাইতেছেন। তথাকথিত ‘অনুপ্রবেশ’ বিষয়ক অস্বস্তি নয়াদিল্লি প্রকাশও করিয়াছে। এই পরিস্থিতিতে আবার নূতন ভাবে সীমান্তরেখা বা নিয়ন্ত্রণরেখা লইয়া অনাবশ্যক জেদের লড়াই চালানো বোকামি নয় কি? চিনের কাছে ভারত এক অনুল্লেখযোগ্য প্রতিবেশী, তাই অর্ধ শতাব্দী পূর্বের যুদ্ধের স্মৃতিটি চিনা জনমানসে উবিয়া গিয়াছে, চিনা রাজনীতিতে অর্থহীন হইয়া পড়িয়াছে। অথচ ভারতীয় রাজনীতিকদের যে সেই যুদ্ধের প্রলম্বিত ছায়া প্রত্যহ আরও বেশি করিয়া তাড়া করিতেছে, এবং যুদ্ধের জুজু দেখাইতেছে, ইহাই কি ভারতীয় মানসে চিনের বিরাট জয় নহে? |