স্বাধিকার, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব ফরাসি বিপ্লবের সময় এই তিনটি শব্দ ব্যবহার করিয়া স্লোগান তৈরি হইয়াছিল। পরবর্তী সওয়া দুইশত বৎসরে তাহাই রেওয়াজ হইয়াছে। সকলেই তিনটি শ্রুতিমধুর শব্দ জুড়িয়া স্লোগান দিয়া থাকে। ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সি বি আই)-ও ব্যতিক্রম নহে। সংস্থাটির মন্ত্র: পরিশ্রম, নিরপেক্ষতা এবং সততা। ৩০ এপ্রিল দ্বিপ্রহরের পর সংশয় হইতে পারে, তবে কি শব্দ তিনটি নেহাতই কথার কথা? নচেৎ কেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তাহাদের এই মর্মে তিরস্কৃত হইতে হইবে যে তাহারা সুপ্রিম কোর্টের বিশ্বাসভঙ্গ করিয়াছে? কেন মহামান্য বিচারকরা বলিতে বাধ্য হইবেন, দেশের সর্বোচ্চ তদন্ত সংস্থার ভিত্তি নড়িয়া গিয়াছে? এই তিরস্কারের মুহূর্তটি ভারতীয় গণতন্ত্রের চরম লজ্জাকর মুহূর্তগুলির একটি। কয়লা বণ্টন সংক্রান্ত দুর্নীতির তদন্তের ভার সি বি আই-এর উপর ন্যস্ত হইয়াছিল। মার্চ মাসে সংস্থাটি সুপ্রিম কোর্টকে জানাইয়াছিল, তদন্তের স্টেটাস রিপোর্ট কোনও রাজনীতিকের নিকট প্রকাশ করা হয় নাই। এপ্রিলের শেষ প্রান্তে আসিয়া সংস্থা আদালতে হলফনামা পেশ করিয়া বলিল, রিপোর্টটি আইনমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার দেখিয়াছেন, প্রধানমন্ত্রীর দফতর এবং কয়লা মন্ত্রকের কিছু আমলাও দেখিয়াছেন। কারণ, ‘তাঁহারা দেখিতে চাহিয়াছিলেন’। এই অসঙ্গতিতে আদালত সঙ্গত কারণেই উদ্বিগ্ন। উদ্বেগের আরও বড় একটি কারণ সি বি আই-এর উপর ‘রাজনৈতিক প্রভু’-দের নিয়ন্ত্রণ। সুপ্রিম কোর্ট যে ভাষায় সি বি আই-কে তিরস্কার করিয়াছে, তাহা কার্যত অভূতপূর্ব। মহামান্য বিচারকরা বলিয়াছেন, সি বি আই-কে মুক্ত হইতে হইবে, স্বাধীন হইতে হইবে। তদন্তকারী সংস্থা হিসাবে সি বি আই যে কাহারও নির্দেশের অধীন নহে, আদালত কথাটি স্মরণ করাইয়া দিয়াছে।
এই তিরস্কার সি বি আই-এর প্রাপ্য। কয়লা বণ্টন মামলাতেই যে তাহাদের রাজনৈতিক আনুগত্য প্রথম প্রকাশ পাইল, তাহা নহে। যে সংস্থা প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের তদন্ত করিতে পারে, তাহা কেন শাসক দলের আজ্ঞাবহ হইয়া থাকিবে? সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলিয়াছে, আইনমন্ত্রী বা কোনও সচিব কি সি বি আই-এর তদন্তের স্টেটাস রিপোর্ট দেখিতে চাহিতে পারেন? তাহার সহিত আর একটি প্রশ্ন জুড়িয়া দেওয়া প্রয়োজন মন্ত্রী দেখিতে চাহিলেও সি বি আই দেখাইবে কেন? উত্তরটি আনুগত্যে আছে। রাজনৈতিক আনুগত্য বহু পথে জন্মাইতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে যদি সি বি আই-এর ন্যায় সংস্থার নির্দেশক নিয়োগের অধিকার থাকে, তবে তাহা আনুগত্য আদায়ের একটি পথ হইতে পারে বটে। সি বি আই-এর নির্দেশক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন। তাহার মাধ্যমেও সরকার সংস্থাটিকে অন্যায় পথে চালনা করিতে পারে। সমাধান কোথায়? চটজলদি উত্তর বলিবে, নির্দেশক নিয়োগের পদ্ধতিটি বদলানো হউক। হয় সি বি আই সম্পূর্ণ স্বশাসিত হউক, অথবা তাহা সুপ্রিম কোর্টের অধীনে থাকুক। তদন্তকারী সংস্থার সহিত সরকারের উচ্চাবচ সম্পর্কটি বিচ্ছিন্ন হউক। সি বি আই নিজেদের এমনই অতলে লইয়া গিয়াছে যে উপরোক্ত বিকল্পগুলি অতি গ্রহণযোগ্য বোধ হইতেছে। কিন্তু, প্রকৃত প্রস্তাবে এই বিকল্পগুলি গণতন্ত্রের মাহাত্ম্যকে খর্ব করে। আইন বাঁধিয়া ন্যায় নিশ্চিত করা অসম্ভব। সি বি আই কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণেই থাকুক, কিন্তু সরকারকে নিশ্চিত করিতে হইবে যে সেই নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা কখনও ব্যবহৃত হইবে না। সি বি আই স্বাধীন ভাবে কাজ করিবে। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তদন্ত করিবে, প্রয়োজনে অতি গুরুত্বপূর্ণ নেতাকেও দোষী সাব্যস্ত করিবে। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাহাকে ব্যবহার না করিবার মধ্যেই প্রকৃত পরিণতমনস্কতার প্রকাশ। ভারতীয় নেতারা সেই আত্মনিয়ন্ত্রণ শিখিয়াছেন কি না, তাহাই গণতন্ত্রের পরীক্ষা। ভারতকে আজ সেই পরীক্ষায় বসিতেই হইবে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত আজ ঘোষণা করিতে বাধ্য হইয়াছে যে সি বি আই তাহার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাইয়াছে। সি বি আই-এর ন্যায় প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতাই গণতন্ত্রের প্রহরী। সেই নিরপেক্ষতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। তাহার দায় কেন্দ্রীয় সরকারের। এই মুহূর্ত হইতে সি বি আই-কে স্বাধীন হইতে দিন। |