আমানত যে একেবারে উবে গিয়েছিল, তা নয়। তবে তার বহর মাসে-মাসে নামছিল। উপরন্তু যা জমা পড়ছিল, তার তুলনায় বেরিয়ে যাচ্ছিল বহুগুণ। যেমন, মেয়াদ শেষে গ্রাহককে টাকা ফেরতের অঙ্কটা সম্প্রতি বিস্তর বেড়েছিল। অন্যান্য খরচেও লাগাম বলতে কিছু ছিল না।
তাতেই নেমেছে ধস। মাত্র চার মাসের মধ্যে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে সারদার সংসার। সংস্থার শেষ চার মাসের হিসাব পরীক্ষা করে এমনটাই মনে করছেন তদন্তকারী অফিসারেরা। যদিও সফ্টওয়্যারের তথ্য অনুযায়ী গ্রাহকেরা যে যত টাকা সারদায় বিনিয়োগ করেছেন, বাস্তবে সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলোয় তার যথাযথ প্রতিফলন নেই। পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব মিলছে না। যা দেখে পুলিশ-কর্তাদের একাংশ কিছুটা চিন্তিত।
চিন্তিত, কারণ সংস্থার সম্পত্তি ও দায় নির্ধারণের স্বার্থে ‘নিখোঁজ’ টাকার হদিস করাটাই আপাতত তাঁদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গোয়েন্দা-সূত্রের খবর, সারদার বিভিন্ন শাখায় আদায়কৃত অর্থের পুরোটা যে ব্যাঙ্কে জমা পড়ত না, সংস্থার কিছু কর্মী সে কথা ইতিমধ্যে পুলিশকে জেরায় জানিয়েছেন। ওঁদের দাবি, সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের নির্দেশ মতোই জমা না-পড়া টাকা নানা ভাবে খরচ হতো, কিংবা পাঠানো হতো অন্য কোথাও। আমানতকারীদের সেই টাকা আসলে কোথায় গিয়েছে, তার খোঁজ শুরু হয়েছে। আর কাজটা যে সহজ হবে না, তদন্তকারীরাই তা কবুল করছেন। “সত্যি বলতে কী, ওই টাকার হদিস পাওয়া এখন যথেষ্ট কঠিন। কারণ, সারদার ১৬০টি শাখায় কোনও ক্যাশ বুক ছিল না। ভাউচার মারফত কত খরচ হয়েছে, তারও হিসেব নেই।” মন্তব্য এক গোয়েন্দা-কর্তার।
ফলে দায় নির্ধারণের জন্য ব্যাঙ্ক-স্টেটমেন্টের উপরে ভরসা করা ছাড়া কার্যত উপায় থাকবে না বলে মনে করছেন তদন্তকারীদের একাংশ। এ ব্যাপারে সংস্থার মালিকের কাছে কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না?
তদন্তকারী-সূত্রের খবর, গায়েব তহবিল প্রসঙ্গে সুদীপ্ত সেন মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তাঁর দাবি, গ্রাহক-আমানতের টাকার সিংহভাগ সংশ্লিষ্ট শাখাগুলো থেকেই খরচ হয়ে গিয়েছে, তিনি কিছু জানেন না। এমনকী, সংস্থার বেশ কিছু এজেন্ট ও কর্তা সফ্টওয়্যারে ভুয়ো নাম তুলে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও তদন্তকারীদের কাছে আক্ষেপ করেছেন সারদা-কর্ণধার। তাঁর এই তত্ত্ব খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
গোয়েন্দা-সূত্রের খবর, ‘সাফারি সফ্টওয়্যার’-এ সারদার ১৬০টি শাখার যাবতীয় আমানতের হিসাব তোলা থাকত। এ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, প্রতি মাসে গড়ে মোটামুটি ৫০ কোটি টাকা আমানত জমা হয়েছে। যার দৌলতে ২০০৫-০৬ সালে লগ্নি-কারবারে নামার পর থেকে গত ছ’-সাত বছরে সারদার ভাঁড়ারে কয়েক হাজার কোটি আসার কথা। কিন্তু সংস্থার অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে এর পুরো হিসেব এখনও মেলেনি। তবে গত নভেম্বরে সমস্যা শুরু হওয়া ইস্তক সারদার আর্থিক বুনিয়াদ কী ভাবে ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুরতর হয়েছে, তার একটা প্রাথমিক ছবি উঠে এসেছে তদন্তে। সেটা কী রকম?
গোয়েন্দা-তথ্য বলছে, ২০১২-র ডিসেম্বরে সারদা সর্বাধিক আমানত সংগ্রহ করেছিল ১৪০ কোটি টাকা। কিন্তু বল্গাহীন ব্যয়ের চাপে তা দিয়েও ধস সামলানো যায়নি। ওই মাসে মেয়াদ-উত্তীর্ণ আমানত বাবদ ৮০ কোটি টাকা ফেরাতে হয়। পাশাপাশি নিয়মিত মাসিক খরচ তো ছিলই। যেমন, হাজার আড়াই কর্মীর বেতনখাতে গড়ে সাড়ে পাঁচ কোটি, সংস্থা পরিচালনায় (ভেন্ডর, রাজনৈতিক দলকে অনুদান, সংবাদমাধ্যম চালানো ইত্যাদি) গড়ে সাড়ে ১৮ কোটি। এ ছাড়া আমানত হিসেবে আদায় টাকার ২৫% এজেন্টরা সরাসরি নিয়ে নিতেন। তদন্তে প্রকাশ, প্রতি মাসে এজেন্ট-কমিশন ও বিভিন্ন শাখায় মেয়াদ-উত্তীর্ণ আমানত ফেরাতেই আদায়ের প্রায় ৮৫% বেরিয়ে যাচ্ছিল। অবশিষ্টাংশের যতটুকু ব্যাঙ্কে জমা পড়ছিল, তা দিয়ে সংস্থা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় ২৪-২৫ কোটির সংস্থান হচ্ছিল না।
ফলে গত ডিসেম্বরে জমার খাতায় ১৪০ কোটি ঢুকলেও উদ্বৃত্ত বলতে বিশেষ কিছু থাকেনি। আগের সব বকেয়া মেটানো যায়নি, সব কর্মীও পুরো বেতন পাননি।
এর পর থেকে নতুন আমানত যেমন কমেছে, খরচের বোঝা বেড়েছে উত্তরোত্তর। যেমন জানুয়ারিতে আমানত-আয় কমে দাঁড়ায় ১১০ কোটিতে। অন্য দিকে ফেরতযোগ্য আমানতের বহর বেড়ে হয় (আগের বকেয়া সমেত) প্রায় ৭৫ কোটি। অন্যান্য খরচেও রাশ টানা যায়নি। ঘাটতির মুখে কর্মীদের বেতন বন্ধ হয়ে যায়, দাঁড়ি পড়ে ভেন্ডর-বকেয়া পরিশোধে। মেয়াদ-উত্তীর্ণ আমানতকারীদের ‘পোস্ট ডেটেড’ চেক দিতে থাকেন সুদীপ্ত, যার অধিকাংশ বাউন্স করে। ফেব্রুয়ারি-মার্চে আদায় আরও কমে, ফেরতের দায়ও বাড়ে। মার্চে ফেরতযোগ্য আমানতের বহর দাঁড়ায় শত কোটিতে।
পুলিশ জানিয়েছে, এই সময়েই সুদীপ্তবাবু বলেছিলেন, ১৬ থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে যাবতীয় পুরনো বকেয়া মিটিয়ে দেবেন, হিল্লে করে দেবেন সব সমস্যার। কিন্তু অত দিন তিনি নিজেই অপেক্ষা করেননি। ১০ এপ্রিল সকালে কলকাতা ছেড়ে পাততাড়ি গুটান সারদা-মালিক সুদীপ্ত সেন।
|