বাবা জ্ঞান দিয়ো না
তোমাকে চাই
রা যাক উত্তমকুমার আর সুচিত্রা সেন মোটরবাইক চড়ে যাচ্ছেন। ঠোঁটে সেই অমর-অক্ষয় গান “এই পথ যদি না শেষ হয়...।” হঠাত্‌ উত্তম বলে বসলেন “তবে কেমন হত তুই বলত!” শুনে কি সুচিত্রা সেনের আগে আপনি-ই ভ্যাবাচ্যাকা?
সত্যি কেমন হত বলুন তো? ‘তুমি’-র জায়গায় এই ‘তুই’ সম্বোধনটা? আরও গাঢ়, আরও নিবিড় ইঙ্গিত দিত রিনা ব্রাউন আর কৃষ্ণেন্দুর সম্পর্কে?
তর্ক লাগতে পারে, উত্তুঙ্গ মতবিরোধও চলতে পারে। কিন্তু এটা তো স্বীকার করবেন যে, বাঙালির ভালবাসার ডাকে জাঁকিয়ে চলছে ‘তুই’-য়ের আধিপত্য। আগে ছিল আপনি অতিক্রম করে তুমি-তে পৌঁছনোর অসম্ভব ভাললাগা মুহূর্তে আরক্ত মুখ, গরম গাল, বুকের মধ্যে উথালপাতাল। আর এখন নৈকট্যের কূল ভাঙার শর্ত মানে ‘তুই।’ এর পক্ষে তার্কিকরা বলতেই পারেন লালনের গানে সব মনের মানুষই তো ‘তুই।’ তুই মানে প্রেমের সঙ্গে বন্ধুত্বকে জড়িয়ে নেওয়া, তুই মানে সম্পর্কে আরও স্বাচ্ছন্দ্য, আরও মুক্তি। সম্বোধনের ধারণার একটা বিবর্তন বা অগ্রগতি আছে। আপনি থেকে তুমি, আর তুমি থেকে তুই-য়ের স্বাভাবিক ক্রমপর্যায় অস্বীকার করবেন কী ভাবে?
তাই বলে ‘তুমি’ কি ফেলনা? রবিঠাকুরের ‘চিনি গো চিনি তোমাকে’ থেকে কবীর সুমনের ‘তোমাকে চাই’-এর রোম্যান্টিকতায় তুমি-র ‘সেনসুয়াস’ আনাগোনা তুলনারহিত। তুমি-পন্থীরা যুক্তি দেন, ‘প্রিয়তমা’ ডাকের পাশে তুমি ছাড়া সব কিছুই বেমানান। ‘ওগো শুনছ’-র আদরের কাছে কি অন্য কিছু লাগে?
তবু একুশ শতকের বাঙালি প্রেমিক আওড়ায়, “ঝিন্টি, তুই বৃষ্টি হতে পারতিস...।” পরিবর্তিত সামাজিকতায়, বদলে যাওয়া প্রেমের ধরনের সঙ্গে মিলেমিশে যায় তুই-য়ের সমীকরণ। তুই মানেই তো তুচ্ছতাচ্ছিল্য নয়। সেই কবে নব্বইয়ের দশকে রূপম গেয়েছিলেন, “তোর ভরসাতে বেঁচে থাকা আর ঠোঁট দু’টো ঠোঁটে রাখা।” নবীন প্রজন্মের এই গায়ক-লেখক বিশ্বাস করেন, “একটা সম্পর্কে তুই আর তুমি দু’টোই সমান্তরাল ভাবে থাকতে পারে। বেশি আদরের মুহূর্তে ‘তুমি’-কে ‘তুই’ বলে ডাকাই যায়। আমার অনেক গানেই খানিকটা তুই, খানিকটা তুমি সম্বোধন আছে।”
‘অটোগ্রাফ’ ছবির দৃশ্য। একে অপরের সঙ্গে দিব্যি
তুই-তোকারি করতেন নন্দনা সেন ও ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তর চরিত্ররা
অনুপমের গানেও তুই-তুমি-র সমান, স্বচ্ছন্দ বিচরণ। কখনও “আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম আর তুই কাকে ভালবাসতি...।” আবার কখনও “আমার আঙুলে-কাঁধে-হাতে তুমি লেগে আছ।” অনুপমের ঘোষণা, “প্রেম তো প্রেমই থাকে, ডাকে কী আসে যায়?”
একটু আগেকার প্রজন্মের হয়তো এসে যায়। কোথাও একটু বাধোবাধো ঠেকে। নবনীতা দেবসেন যেমন বলেন, “এখন ‘আপনি’ দূরে থাক, ছেলেমেয়েরা কত অনায়াসে অপরিচিতকে ‘তুমি’ বলে ডাকতে পারে। আমার কাছে অনেকে চিঠি পাঠায় ‘তুমি’ বলে। অপরিচিতের সঙ্গে তুমির নৈকট্য ভাল লাগে না আমার। এখানে আপনিটাই কাম্য।” অঞ্জন দত্ত-ও কট্টর তুমিবাদী। “তুমি শব্দটার মাধুর্য, ব্যক্তিত্বই আলাদা। তুই-য়ে সেই ম্যাজিক নেই। কেমন যেন বাত্‌সল্য আছে। তুমি মানেই প্রগাঢ় প্রেম আর যৌনতার মিশেল। এর ব্যঞ্জনাই আলাদা,” বলেন অঞ্জন।
নবনীতার অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত বই-য়ে লেখিকা লেখেন ‘এমন জুটি অন্তত আধ ডজন তো ভালভাবেই চিনি যারা বিয়েও করে ফেলেছে, আজও তুইতোকারি চলছে...। এখন ‘আপনি’ মানেই যেমন শ্রদ্ধা-সম্মান দেখানো নয়, ‘তুমি’ও তেমন অন্তরঙ্গতার পরাকাষ্ঠা প্রমাণ করে না। আবার ‘তুই’ মানেই নয় ভাই-বোনের অনাবিল প্রীতি।’
সুইস পার্কের দেবযানী আর পবিত্র মুখোপাধ্যায় সব শুনে মুচকি হাসেন। সম্বন্ধ করে বিয়ে। প্রথম ১০-১২টা বছর দিব্যি ওগো-হ্যাঁগো-তে ছিলেন, আচমকা কবে থেকে যেন বিপজ্জনক ভাবে সেটা তুই হয়ে গেল। দেবযানী অনেক ভেবে বলেন, “ও একবার অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছিল। রাতে ফোনে গল্প করছি, হঠাত্‌ দুষ্টুমি করে ‘তুই’ ডেকে বসল। আমিও বললাম। বেশ লাগল, চলতে লাগল। এখন মেয়েরা আমাদের খেপায়। ওদের সামনে কম বলি। ওই যে কথায় বলে না, বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন হয়ে যায়, আমাদের তুই ডাকটা বোধহয় তার হাতেগরম প্রমাণ।”
পবিত্রবাবু বৌকে থামিয়ে যোগ করেন, “আসলে সম্পর্কে যখন রোম্যান্সের উত্তেজনা কমে, রহস্যময়তা থাকে না, দৈনন্দিন জীবনচর্চা, ওঠাবসা টিকে থাকে, তখন অনেকেরই সম্বোধনে তুই আসে। আমার মতে দাম্পত্য বা প্রেমে ‘তুই’ ঢুকছে মানে দৈনন্দিনতায় ক্লিশে হচ্ছে সম্পর্ক। ম্যাজিক হারাচ্ছে। সতর্কতা বাঞ্ছনীয়।”
এই যুক্তি কিছুতেই মানবেন না আঁখি আর নন্দন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, সেকেন্ড ইয়ার। “আরে বাবা এখন তো আর অপরিচিত-অপরিচিতার বিয়ের যুগ নয়। বেশির ভাগ প্রেমিক-প্রেমিকাই সহপাঠী বা একই কলেজের উপর-নীচের ইয়ার, কলিগ, দাদা বা বোনের বন্ধু। প্রেম দানা বাঁধার আগে সম্বোধনটা তুই ছিল। সম্পর্ক বদলালে কি এক কথায় ডাক বদলে যায়? ভালবাসা তার জায়গাতেই থাকে।” সেক্টর ফাইভে একই অফিসের সহকর্মী সুনীপা-দ্বৈপায়নও পরস্পরের কাছে ‘তুই।’ বলেন, “তুইটা খারাপ কি? প্রেমের ডাকে তুই এখন নিজের সিলমোহর দিয়ে দিয়েছে। সময়টা তো আর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই।” তবে সমস্যা তৈরি করেন আশপাশের লোক। বিশেষ করে বিয়ের পর তুই চললেই হাজারো কৈফিয়ত দিতে হয় বাড়ির লোককে।
আত্মীয়স্বজনের বারণ শেষ হয় না। “স্বামী-স্ত্রীতে আবার তুই-তোকারি কীসের? বাচ্চা হলে তারা কি দেখবে বাবা-মা তুই-তোকারি করছে!” ইত্যাদি-প্রভৃতি নানা যুক্তির বাণ ছুটে আসে। সামলানো মুশকিল হয়।
তেমনই মুশকিল হঠাত্‌ করে তুই থেকে তুমি-তে যাওয়া। পবিত্র সরকার হাসতে হাসতে বলছিলেন নিজের জীবনের কথা। সহপাঠিনীকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের আগে তুই বলতেন। বিয়ের পর তুমিতে যেতেই হয়েছিল। তাঁর কথা, “তুই-এ যদি অন্তরঙ্গতা বাড়ে বলে মনে হয় আপত্তি কীসের? অনেক অন্ত্যজ বা প্রান্তিক জাতির মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসার ডাক তুই। আমরা, শিক্ষিতেরা, হয়তো একটু অন্য ভাবে ভাবতাম। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে, তখন আমরা ছাত্র। প্রবোধকুমার সান্যালের ‘আঁকাবাঁকা’ নামে একটা উপন্যাস প্রকাশিত হল। তাতে প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরকে তুই বলে। আমরা তো রোমাঞ্চিত। সেই সময় এটা একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার।”
সত্যি সে একটা সময় ছিল বটে। ভানুদাদা-র জন্য মন কেমন করলে রানু যখন চিঠিতে ‘আপনি’ সম্বোধন করে তাঁকে ‘অনেক চুমো’ দিতেন। প্রমথ চৌধুরী আর ইন্দিরা ঠাকুর তাঁদের প্রেমপর্বে অনেকটা এগিয়ে তবে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’-তে নোঙর করতেন। তার পর প্রমথ খুব জোরজার করছেন, চিঠিতে তাঁকে নাম ধরে সম্বোধন করতে হবে ইন্দিরাকে। ইন্দিরা কিছুতেই আগল ভাঙতে পারছেন না। শেষে ঠিক হল, সম্বোধন করা হবে ‘মন আমি’ বলে।
বছর চল্লিশ আগেও ‘তুই’ দূরঅস্ত, প্রেমে তুমি-তে আসাটাই ছিল চূড়ান্ত সাফল্য। শঙ্খ ঘোষের ‘এখন সব অলীক’-এ যেমন গল্প বলা রয়েছে প্রেসিডেন্সির ছাত্র জীবনের। সেখানে তিনি লিখছেন ‘কখনও কখনও কথার বিনিময়ও হতে পারে সহপাঠীদের সঙ্গে, কিন্তু সে বিনিময়ে পরস্পরের প্রত্যাশিত সম্বোধন হয় ‘আপনি।’ দৈবে কেউ-কাউকে ‘তুমি’ বলেছে শুনলে গোটা কলেজের পক্ষে সে হয়ে ওঠে এক রোমাঞ্চকর সংবাদ এবং ভাবী নানা রঙিন সম্ভাবনার অলীক কল্পনায় অনেক হৃদয়ক্ষত তৈরি হতে থাকে কোণে কোণে।’
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অবশ্য মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী। তাঁর মতে, “তুই-তুমি, যাতে যে স্বচ্ছন্দ সেটাই ডাকা হোক। তবে দেখতে হবে প্রেমটা যেন থাকে। ভালবাসায় দায়িত্ববোধটা যেন চলে না-যায়।”
তুই-তুমি বিতর্কে আড়াল থেকে মুচকি হাসে ‘ইউ’। ইংরেজি ভাষার এটা একটা বিরাট সুবিধা। তুমি থেকে তুই, সব এই ওই এক ‘ইউ’-এ বন্দি। লড়াইয়ের জায়গাই নেই। আই নিড ইউ, আই লাভ ইউ, আর হেট ইউ বলার লক্ষ্য তুমি না তুই, সেটা নিজের মতো ভেবে নিলেই হল। সম্বোধনে সব সময় বাত্‌সল্য বা রোম্যান্টিকতার নিক্তি মাপাটাই যে দুরূহ।

আমি তো তুই করেই বলি। গার্লফ্রেন্ডকে তুমি বলব ভাবতেও পারি না। আমাদের প্রজন্মে এসএমএস চলে, স্কাইপ চলে...এটা তো চিঠির যুগ নয়। সব কিছু ছোট হতে হতেই ‘তুমি’টা ‘তুই’ হয়ে গিয়েছে
সমদর্শী দত্ত

কলেজে জীবনের প্রথম প্রেমিকাকে তুই বলেই ডাকতাম। এই ডাকে জড়তা অনেক কম ছিল। প্রেমে আদর করে তুই আসতেই পারে। আমার মনে হয়, একই সম্পর্কে পাশাপাশি তুই-তুমি চলতে পারে
রূপম ইসলাম

বিয়ের আগেও তুই করে বলতাম, পরেও তাই বলি। এখন আর অভ্যেসটা বদলাতে পারব না
গৌরব চট্টোপাধ্যায়



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.