এ কেমন ভালবাসা কে জানে
ক্যালেন্ডারের হিসেবে আজ মান্না দে-র জন্মদিন।
কিন্তু আমার কাছে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই মান্না দে-র জন্মদিন। কারণ আমি প্রত্যেক দিনই ওঁর গাওয়া দু’তিন খানা গান শুনি। সেই গানের উপস্থাপনা থেকে নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করি।
মুক্তমনা মান্না
তবু যদি এ প্রশ্ন আমাকে করা হয় আজ তাঁর জন্মদিনে ওঁর গাওয়া কী গান শুনব, তা হলে বলব এমন কয়েকখানা গান শুনতে চাই, যেগুলো খুব প্রচলিত নয়, কিন্তু গান হিসেবে দুর্দান্ত। মান্নাবাবুর গাওয়া মালয়ালম ভাষায় এমন অনেক বিভোর করা গান আছে। আজ ইউ টিউবে হোক বা নেটে গিয়ে সেই সব অচেনা সুন্দর গানেরই খোঁজ করব। হিন্দি বা বাংলা ভাষার গানের বাইরে উনি যে সব গান গেয়েছেন সেখানে আর এক অন্য মান্না দে-কে পাওয়া যায়, যিনি মুক্তমনা। খোলা মনে চারপাশের পৃথিবী থেকে অনেক সুর, অনেক গান আহরণ করেছেন সারাটা জীবন।
এক জন বড় শিল্পী হতে গেলে মান্নাবাবুর মতো খোলা মন থাকা খুবই জরুরি। মন যত খোলা থাকবে, ততই নানা দেশের গান, সুর মনের রাজ্যে ঢুকতে পারবে।
একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সে দিন মান্নাবাবুর মেজাজ খুব ভাল। কলকাতার একটা রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়া, আড্ডা জমেছিল। সেখানে একজন গায়ক-অভিনেতা যত দূর মনে পড়ছে একটা ল্যাটিনো গেয়েছিলেন। মান্নাবাবু তাঁর গান শুনে অভিভূত। বললেন, “আমি যদি তোমার মতো গাইতে পারতাম!” দেখেছিলাম একটা বিদেশি গান শুনে কী অনাবিল উচ্ছ্বাসে ভেসে গেলেন তিনি। এখনকার তরুণ শিল্পীরা কে কতটা অন্য সব দেশি-বিদেশি গান শোনেন জানি না। মান্নাবাবুর মতো খোলা মন রাখলে তাঁদের গান আর সুরের জগত্‌টা কিন্তু অনেক বেশি প্রসারিত হতে পারে।

আসর জমিয়ে দিতেন গ্রিনরুমেই
এ সব কথা বলছি কারণ মান্নাবাবুর মতো শিল্পী যদি রোল মডেল হন, তা হলে যে কোনও শিল্পীর জীবনের ফোকাসটাই পাল্টে যাবে। গানকে ভালবেসে আত্মহারা হওয়া কি তীব্র রূপ নিতে পারে তা এক বার দেখার সুযোগ এসেছিল আমার। দুর্গাপুরে একটা বড় অনুষ্ঠানে মান্নাবাবুর গাওয়ার কথা, আমি সেখানে গায়ক হিসেবে আমন্ত্রিত। ঘটনাক্রমে আমরা একই হোটেলে উঠেছিলাম। বিকেল চারটের সময় শুনতে পেলাম মান্নাবাবু দরাজ গলায় রেওয়াজ আরম্ভ করলেন। ঘণ্টাখানেক রেওয়াজের পর সওয়া পাঁচটা নাগাদ মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে রিহার্সালে বসলেন। ওঁর তো রাত আটটায় স্টেজে গান গাওয়ার কথা। তার অত আগে থেকে রিহার্সাল দেওয়া হচ্ছে শুনে সে দিন দারুণ অবাক হয়েছিলাম। অবাক হওয়া সত্তেও একটা ব্যাপার বুঝেছিলাম কী সাঙঘাতিক নিষ্ঠা, একাগ্রতা ওঁর গানের প্রতি।
এতখানি রেওয়াজ না করলেও তো উনি ভালই গাইতেন, কিন্তু এই যে ডিসিপ্লিন এবং নিষ্ঠা এটাই তো ওঁকে অত বড় মাপের শিল্পী করেছে। শুনেছি উনি নাকি বিভিন্ন ফাংশনের আগে গ্রিনরুমেই রিহার্সাল করতে করতে আসর বসিয়ে দিতেন। গেয়ে চলতেন একটার পর একটা গান। উনি তখন এতটাই মগ্ন হয়ে যেতেন যে ভুলেই যেতেন সময় এগিয়ে চলেছে। শেষকালে নাকি উদ্যোক্তারা উদগ্রীব হয়ে ছুটে এসে মনে করিয়ে দিতেন স্টেজে ওঠার সময় হয়ে গিয়েছে।
তখন মান্নাবাবুর সম্বিত্‌ ফিরত!

শিখতে হয় নিয়মানুবর্তিতা
শুনতে অদ্ভুত শোনালেও বলব, বড় জাতের শিল্পী হতে গেলে সত্তার মধ্যে এক ধরনের বেহিসেবি উন্মাদনাও থাকা দরকার। থাকা দরকার এক ধরনের আত্মহারা ভাবও। মান্নাবাবুর মধ্যে সেটা দারুণ ভাবে আছে। এক কথায় বলতে গেলে আবেগপ্রবণ হওয়াটা শিল্পীর পক্ষে খুব জরুরি। কিন্তু আজকালকার শিল্পী-জীবন সময়ের নিয়মে পাল্টেছে। সেখানে পেশাদারিত্ব এত বেশি, সব কিছু এত মাপা হয়ে গিয়েছে যে আবেগের জায়গাটা গৌণ হয়ে গিয়েছে। আবেগ থাকলে তবেই না এই চুরানব্বই বছরের জন্মদিনে দাঁড়িয়ে মান্নাবাবুর মতো শিল্পী নতুন গান রেকর্ড করার স্বপ্ন দেখেন!
নিজেকে নানা ভাবে লালন করে এসেছেন মান্নাবাবু। আজীবন তিনি ‘ডিসিপ্লিনড’ মানুষ। ভোরবেলা কুস্তির আখড়ায় শরীরচর্চা করে এসে রেওয়াজ করতে বসতেন। হয়তো তিনি জানতেন শরীরের যত্ন নিলে তবেই অনেক দিন ধরে সুস্থ সবল ভাবে গান গাওয়া যাবে। কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মতো বিখ্যাত গায়ক তাঁর কাকা এবং গুরু হওয়া সত্ত্বেও জানতেন নিজের পথ নিজেকেই গড়তে হবে। কেউ সোনার চামচে করে সাফল্য মুখে তুলে দেবে না। এই সত্যটা বুঝতেই অনেকের অনেক সময় লেগে যায় আজকাল। মাঝখান থেকে সংগ্রাম করার মানসিকতাটাও হারিয়ে যায়। যিনি যত বড় ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেই আসুন না কেন, সংগ্রাম করতেই হবে। আর সেটা মান্নাবাবুকে দেখেই শিক্ষণীয়।

উত্তর দিতে কুণ্ঠা হয়
আজ খুব মনে পড়ছে সে সব দিনের কথা। আমার তখন বছর সাতেক বয়স। পুজোর সময় ভবানীপুরে মামার বাড়িতে যেতাম। পুজো প্যান্ডেলে ষষ্ঠীর দিন জলসা হত। সেই জলসায় আমাকে এক বার গান গাইতে বলা হল। আমাদের বাড়িতে তখন মান্নাবাবুর রেকর্ড কেনা হচ্ছে। আমি সেখান থেকেই কয়েকখানা গান শিখেছিলাম। ফাংশনে গাইলাম ‘ও ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না।’ গান গাওয়ার পর আমাকে তো সবাই খুব প্রশংসা করল। মান্নাবাবুর গানকে আমি শ্রদ্ধা করতে আরম্ভ করলাম। বছর তেরো যখন বয়স, কানে এল ‘আমি কোন পথে যে চলি’ কিংবা ‘বাঁচাও কে আছো মরেছি যে প্রেম করে’র মতো কমেডি গান। অল্প বয়সের বুদ্ধিতেই বুঝতে শুরু করলাম এক জন ভার্সেটাইল শিল্পীর সাক্ষাত্‌ পেয়ে গিয়েছি আমরা। আমি কোনও দিন কোনও গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে গান শিখিনি। ক্রমে ক্রমে সেই বয়ঃসন্ধিতেই মনে মনে তিনি হয়ে উঠলেন আমার গুরু। হয়ে উঠলেন আমার সুরের জগতের নিভৃত প্রাণের দেবতা।
কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন তিনিই আমার নিজস্ব দ্রোণাচার্য কি না, তা হলে উত্তর দিতে কুণ্ঠিত হব। কারণ শিষ্য হিসেবে অতটা বড় মাপের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করাতে পারব না। তবে মনে মনে ওঁকে সত্যিকারের ভার্সেটাইল আর্টিস্ট মেনে স্তুতি করেছি সারা জীবন। এখনও প্রায় প্রত্যেক দিন ওঁর গান শুনি। কিন্তু ওঁর সঙ্গে আমার কোনও গভীর আলাপ পরিচয় কোনও দিনই হয়নি।
গত বছর কয়েক জন শিল্পীর একটি গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছিল। সেই অ্যালবামের নাম ‘তাই তুমি আমার।’ গানগুলি লিখেছিলেন ড. অলক পাত্র। সুরকার ছিলেন সুপর্ণকান্তি ঘোষ। ‘তাই তুমি আমার’ গানখানা আমি গেয়েছিলাম। এই গানটি রচনা করা হয়েছিল মান্নাবাবুর স্ত্রী সুলোচনা দেবীকে ভেবে। শুনেছিলাম মান্নাবাবু এই গানটি শুনেছিলেন রেকর্ডিংয়ের আগে। এবং নিজে স্ত্রীর স্মরণে গানটি গাওয়ার খুব আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু শরীর ভাল ছিল না বলে গাইতে পারেননি। আমার গাওয়া গানটি শুনে মান্নাবাবুর খুব ভাল লেগেছিল। ওঁর সেই প্রশংসা আমার কাছে বিরাট পুরস্কার।

প্রত্যেকটা গান ছিল চ্যালেঞ্জ
কেন বারবার বলছি মান্নাবাবু আমাদের মতো শিল্পীদের অনুপ্রেরণা? তার কারণ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ এমনটা ঘটেনি ওঁর ক্ষেত্রে। মুম্বইতেও তখন কঠোর প্রতিযোগিতা। তালাত মেহমুদ, মহম্মদ রফি সাহেবরা তখন বীর বিক্রমে রুপোলি পর্দার সুরের রাজ্য সামলাচ্ছেন। দুর্ধর্ষ স্বকীয়তা নিয়ে এসে পড়লেন কিশোরকুমারও। মোট কথা নায়কের গান বাদ দিয়ে যে উদ্বৃত্ত গান পড়ে থাকত তাই মান্নাবাবু গাইতেন হৃদয় আর সুরের সবটা উজাড় করে দিয়ে। এ সবের ফলে গায়ক হিসেবে মান্নাবাবুর কাছে প্রত্যেকটা গানই নিজেকে দুরন্ত প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াত। এই সব গানেই রাখতে হত মান্না দে-র নিজস্ব ‘সিগনেচার’।
‘পুছো না ক্যয়সে ম্যয় র্যান বিতায়ী’, ‘কসমে ওয়াদে প্যায়ার বফা’, ‘ইয়ারি হ্যায় ইমান মেরা’ ‘দূর হ্যায় কিনারা’ কিংবা ‘অ্যায় মেরে প্যায়ারে ওয়াতন’ এই সব গান যার একটার সঙ্গে আরেকটার কোনও মিল নেই, একটা কাওয়ালি, তো অন্যটা মাঝিমাল্লার গান অনায়াসে গেয়ে দিতেন। এই সব গানের গায়নভঙ্গি এমন যে সচরাচর কপি করে গাওয়া যায় না। মান্নাবাবুর গান তাঁর একান্ত নিজস্ব শৈলীতে তাঁরই থেকে যায়। স্বরলিপি দিয়ে ধরা যায় না তাঁর গানের অনন্য আমেজ। স্বরলিপিকে ছুঁয়ে থেকেও সুরের ধরা ছাড়ার স্টাইলকে এমন একটা না বলা মূর্ছনায় নিয়ে যেতেন যা অন্য গায়কদের পক্ষে আয়ত্তে আনা কঠিন।

অনুকরণের বাইরে
সেই জন্যই হেমন্ত-কণ্ঠ, কিশোর-কণ্ঠ, এমনকী রফি-কণ্ঠ শিল্পী যত পাওয়া যায় মান্না-কণ্ঠ শিল্পী তত পাওয়া যায় না। কিন্তু হ্যাঁ মান্নাবাবুর গানের পরম্পরা যে এক কাল থেকে আর এর কালে প্রবাহিত হয়নি তা নয়। বহু শিল্পীই আছেন যাঁদের গান শুনলে বোঝা যায়, তাঁরা মান্না দে-র গায়ন ভঙ্গিতে বা স্কুলিংয়ে দীক্ষিত। তাঁদের নাম আমি করতে চাই না। পাঠকেরাও যদি একটু খেয়াল করে গান শোনেন বুঝতে পারবেন আজকের কোন কোন গায়কের মধ্যে দিয়ে বেঁচে আছে মান্না ঘরানা।
তবে এত কিছুর পরেও বলব তিনটি গানের কথা, যেগুলি কিছুতেই অনুকরণ করা যায় না। যেমন ‘চলত মুসাফির মোহ লিও রে’ গানটা। সুর সহজ। কিন্তু ভাষাটি দেহাতি। উচ্চারণের মধ্যে একটা গ্রাম্য সাবলীলতা না থাকলে গানটি গাওয়া কঠিন। ‘পুছো না ক্যয়সে ম্যয় র্যান বিতায়ী,’ আহির ভৈরব রাগাশ্রিত গান। ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি’ গানটির ছায়া আছে। এই বিরহের গানে যে বেদনা আছে তা চোখ ভিজিয়ে দেয়। মান্না দে যে দরদ দিয়ে গানটি গেয়েছেন তা সহজে অনুকরণ করা সম্ভব নয়।
‘আমি যে জলসাঘরে’উত্তমকুমারের লিপে এই গান। ক্ল্যাসিকাল ঘরানার গান স্বরলিপি দেখে গাইলেও মান্না কণ্ঠে এ গানের যে এক্স-ফ্যাক্টর আছে তা ব্যাখ্যা করা কঠিন। গাওয়াও সোজা নয়।
সহজাত শিল্পীর দক্ষতা নিয়ে কিশোরকুমার যেখানে মুম্বই জগত্‌ কাঁপাচ্ছেন, সেখানে শিল্পী হিসেবে মান্নাবাবু কাওয়ালি থেকে ক্ল্যাসিকাল গানের গুরুগম্ভীর জ্ঞান নিয়ে কোথাও যেন একটা দূরত্বে রয়ে গিয়েছিলেন। যখনই গান গাইছেন তা হিট করছে, তা সত্ত্বেও এই ব্যাখ্যাতীত দূরত্ব সেই সময় কেন তৈরি হয়েছিল তার কারণ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। হয়তো সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর অতিরিক্ত পাণ্ডিত্যই কিছুটা তাঁকে দূরতর গ্রহ করে রেখেছিল।

বাংলা গানের দরবারে
বলিউডে যথার্থ জায়গা করার পরই বাংলা তাঁর কদর বুঝেছিল। এও এক ভাগ্যের পরিহাসই বলা চলে। কলকাতায় জন্ম, বাংলার সঙ্গীত মজ্জায় বয়ে বেরিয়েও এত দেরিতে কেন তিনি বাংলা গানের দুনিয়ায় এলেন এর উত্তরও দুরূহ। সেই সময়টা উত্তমকুমার বাংলা ছবির রুপোলি পর্দায়। তাঁর লিপে অনবদ্য হয়ে উঠছে একের পর এক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান।
উত্তম-হেমন্তের অমোঘ জুটি বদলে তখন শুরু হল উত্তম- মান্নার যুগ। উত্তমের লিপে যখন গান গাইতে আরম্ভ করলেন তা যেন অন্য একটা রোম্যান্সের বাতাবরণ তৈরি করল। শুধু উত্তমকুমারই নন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লিপেও কালক্রমে এসে গেল তাঁর গান। ‘শঙ্খবেলা’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’, ‘স্ত্রী’, ‘ছদ্মবেশী’র পাশাপাশি সৌমিত্র অভিনীত ‘তিন ভুবনের পারে’, ‘প্রথম কদম ফুল’এর গানগুলো তখন মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। বাঙালি তখন খুঁজে পেয়েছে বাংলা গানের নতুন দেবদূতকে।

জাত অভিনেতা
মান্নাবাবুর গানের ব্যবসায়িক সাফল্যের পেছনে ছিল আর একটা বড় গুণ বা বিশেষত্ব। উনি গানের সাহিত্যের দিকটা বা বাণীর দিকটায় চিরকালই বেশ জোর দেন। কী সিনেমার গান, কী আধুনিক গান সর্বত্রই গানের ভাব অনুসারে একটা নাটকীয়তা ধরার চেষ্টা করেছেন। গানের জনপ্রিয়তার আরেকটা কারণ হল গান গাইবার সময় ওঁর মধ্যে একজন অভিনেতা অভিনয় করতেন। যেখানে মেলোড্রামার দরকার নেই সেখানে গানের মধ্যে মেলোড্রামা আনতেন না। যখন নাটক দরকার সেখানে নাটক মিশিয়ে দিতেন।
‘ভূত বাংলা’ ছবির গান ‘আও টুইস্ট করে’তে মেহমুদের ম্যানারিজম বা ‘মেরা নাম জোকার’এ রাজ কপূরের কথা বলা, চালচলন, ভাবভঙ্গি তিনি ‘এ ভাই জারা দেখকে চলো’তে স্পষ্ট ধরেছেন তাঁর শব্দক্ষেপণে। প্লে-ব্যাকের সময় বিশেষ করে তিনি যে অভিনেতার গান গাইছেন, তাঁর হাবভাব গানের মধ্যে ফুটিয়ে তোলায় ছিলেন অদ্বিতীয়। ‘শঙ্খবেলা’র ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ যখন গাইছেন তখন বোঝা যায় নায়কনায়িকার একান্ত ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের গান গাইছেন তিনি। আবার ‘জিন্দেগি ক্যয়সি হ্যায় পহেলি’ গানে তাঁর সুর মিশে গিয়েছে বিশ্ব চরাচরের আকাশে বাতাসে।
আর একটা কথা, ভারতীয় মার্গ-সঙ্গীত, লোকসঙ্গীতের পাশাপাশি মান্নাবাবু ওয়েস্টার্ন মিউজিকও দারুণ চর্চা করতেন। পছন্দ করতেন ন্যাট কিংকোল, জিম রিভস। ওঁর বহু গানেই আশ্চর্য ভাবে পশ্চিমী প্রভাব এসে গিয়েছে যেটা হয়তো বা সাধারণ শ্রবণে নাও ধরা পড়তে পারে। যেমন ধরা যাক ‘আমি আগন্তুক, আমি বার্তা দিলাম’ গানটিতে ওয়েস্টার্ন এলিমেন্ট রয়েছে।
তাঁর ভয়েস ট্রেনিংয়ে এই পশ্চিমী প্রভাব ছাপ ফেলেছে ‘জিন্দেগি ক্যয়সি হ্যায় পহেলি’র মতো গানের দীর্ঘ উদাত্ত টানে। ‘যদি কখন একান্তে/চেয়েছি তোমাকে জানতে’ তে সুরটাকে হ্রস্ব করে দিয়েছেন। এও ওয়েস্টার্ন স্টাইল। এই রকম অনেক গানেই পাওয়া যায় বিদেশি অনুষঙ্গ।

প্রেমের গানের ম্যাজিক
মান্নাবাবুর প্রেমের গান বা বিরহের গান যে এত সফল হয়েছে তার কারণ তাঁর পরিমিতি বোধ। বিরহের গানে এক ধরনের বেদনা জড়িত হয়ে থেকেছে, এক ধরনের মিউজিক্যাল প্যাথোস তৈরি করেছে, কিন্তু কখনওই প্রেমের প্যানপ্যানে ব্যাপারটা তাঁর গানে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। সেই জন্যই সে সব গান আশ্চর্য বিরহলোকে উত্তীর্ণ হয়েছে।
সব বড় মাপের পুরস্কারই আজ তাঁর সঞ্চয়ের ভাণ্ডারে। তবু খুব ভাল লাগল সম্প্রতি যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বেঙ্গালুরুতে গিয়ে বিশেষ ভাবে সম্মানিত করে এলেন। আজ জন্মদিনে কত মানুষই তো তাঁকে ফোন করবেন। আমি জানি তাঁদের মধ্যে আছেন লতা মঙ্গেশকরও। তাঁর ভক্ত ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্ব জুড়ে। তাঁরাও তো মনে মনে শিল্পীকে প্রণাম জানাবেন।
এই জন্মদিনের প্রহরে আমার শুভেচ্ছাযে গান তাঁর জীবনের মহার্ঘ সম্পদ, ঈশ্বর যেন তা তাঁর কণ্ঠে অক্ষয় করে রাখেন। তিনি যেন সুস্থ থাকেন, ভাল থাকেন।
আর যে রেকর্ডটি করার পরিকল্পনা করছেন তা যেন রূপায়িত হয়। একটা শুধু আক্ষেপ রয়ে গেল।
মান্নাবাবু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে খুব ভালবাসেন। তা সত্ত্বেও তিনি কেন যথেষ্ট পরিমাণে রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করলেন না?

প্রিয় মান্না মুহূর্ত
এখনও প্রতিদিন রাত্রে বাড়ি ফেরার সময় ওঁর গান শুনি।
এক এক করে যখন ‘আমি নিরালায় বসে’, ‘যদি কাগজে লেখ নাম’ বা
‘আবার হবে তো দেখা’ চলে, আমার সারাদিনের ক্লান্তি উধাও হয়ে যায়

ড. সুব্রত মৈত্র

আমার সবচেয়ে পছন্দের গান হল, ‘তু প্যায়ার কা সাগর হ্যায়’।
গানটার ডিএনএ-তে রয়েছে বিরহ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরহ নিয়ে লিখেছিলেন।
মান্না দে সেই ভাবটাই সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন
মহেশ ভট্ট

অল্প বয়সে মন ভরিয়ে দিয়েছিল ‘জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি।’
মানে বুঝিনি তখন। তখন কে গেয়েছেন গানটা জানতাম না।
যখন মান্না দের নাম জানলাম তখন ওঁর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেল

হর্ষ নেওটিয়া
‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আর নেই’এই গানটাই আমার কাছে সেরা মান্না মুহূর্ত।
ওঁর এই গানটার সঙ্গে আমি সব চেয়ে বেশি একাত্ম বোধ করি।
এ গানটা শুনলে মনটা স্মৃতি ভারে আক্রান্ত হয়

যোগেন চৌধুরী

যখন বাংলার অধিনায়ক ছিলাম, আমার ক্রিকেট-কিটে দু’জনের ক্যাসেট থাকতই।
জর্জ বিশ্বাস ও মান্না দে। প্রত্যেকম্যাচের আগের দিন নিজের ঘরে ‘কফি হাউস...’
শোনা ছিল আমার রুটিন

সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছবি: উত্‌পল সরকার



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.