প্রবন্ধ ১...
ক্ষতিপূরণ নিয়ে প্রশ্ন এড়ানোর উপায় নেই
সারদাকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েক লক্ষ (না কি কয়েক কোটি?) মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকার। ৫০০ কোটি টাকা প্রাথমিক ভাবে বরাদ্দ করা হচ্ছে বলে ঘোষণা করেছেন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী। বিপর্যয়ের ব্যাপকতার বিচারে এবং এর সামাজিক রাজনৈতিক অভিঘাতের কথা মাথায় রাখলে সরকারের দিক থেকে এমন তাৎক্ষণিক পদক্ষেপই স্বাভাবিক বলে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথম ধাক্কার প্রতিক্রিয়ায় সরকারের দিক থেকে যখন আরও কড়া আইনের কথা হচ্ছিল, কার গাফিলতিতে আজও সেই আইন প্রণয়ন হয়ে উঠল না, রাজনৈতিক চাপান-উতোর চলছিল তা নিয়ে, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছিল, যে মানুষগুলি সর্বস্বান্ত হলেন, তাঁদের জন্য এই মুহূর্তে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? কতকটা যেন এই প্রশ্নের চাপেই তড়িঘড়ি এমন ঘোষণা ছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর হয়তো উপায় ছিল না। ঘোষণার পর আবার নতুন বিতর্ক। সিগারেটে অতিরিক্ত কর বসানোর যৌক্তিকতা, কর বাবদ আয় কত হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা, সবাইকে বেশি-বেশি সিগারেট খেতে বলার (হালকা ভাবে হলেও) নৈতিকতা, ইত্যাদি।
বিপর্যস্ত মানুষের পাশে সরকার দাঁড়াবে, এ দাবি যেমন ক্ষতিগ্রস্তদের, তেমনই বিরোধীদেরও। ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে সরকারও যেন তা মেনে নিল। ফলত দেখা গেল, রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের কেউই ক্ষতিপূরণের যুক্তি ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ দেখছেন না। এর দু’টি কারণ হতে পারে। এক, তাঁরা সত্যিই মনে করেন, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত। দুই, তাঁরা যদি ক্ষতিপূরণের ন্যায্যতা নিয়ে সংশয়ীও হন তবু প্রকাশ্যে তা বলছেন না, পাছে দরিদ্র বিপর্যস্ত মানুষের প্রতি অনুভূতিশূন্যতার বদনাম কুড়োতে হয়। প্রশ্নটা হল, সরকারি অর্থে ক্ষতিপূরণের এই নীতি কতটা ন্যায্য?
ধরা যাক, কোনও দরিদ্র মানুষ তিল-তিল করে সঞ্চয় করেছেন। এক দিন সেই সঞ্চিত অর্থ চুরি হয়ে গেল। তিনি কিন্তু অনেক লাভের স্বপ্ন দেখে সঞ্চিত অর্থ অন্ধকারে সঁপে দেননি। যা-ই হোক, চোরকে ধরা গেল না। ধরা গেলেও সে অর্থ যে ফিরে আসত, তাও বলা যায় না। এমতাবস্থায় সরকার কি এগিয়ে এসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষটিকে অর্থসাহায্য করে? করে না। যদিও অনেকেই মনে করতে পারেন, করা উচিত। বিশেষত এ ক্ষেত্রে মানুষটির তো কোনও দোষ নেই, তিনি বিষাক্ত চোলাইও খাননি কিংবা সারদায় টাকাও রাখেননি। ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, সরকার এমন কাজ হয়তো এক বার কোনও বিশেষ উপলক্ষে করতে পারে। কিন্তু একে নীতি করে ফেললে বিপদ আছে মানুষ সঞ্চিত অর্থের সুরক্ষায় আদৌ যত্নবান হবেন না, কারণ সরকার তো রয়েছে ক্ষতিপূরণের ঝুলি নিয়ে। আবার, এক বার সরকার যদি এমন পরিস্থিতিতে ক্ষতিপূরণ দেয়, তা হলে দ্বিতীয় বার অনুরূপ পরিস্থিতিতে না দিলে সমালোচিত হবে। এ এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। সরকার যদি এক বার সাহায্য করে এবং দ্বিতীয় বার না করে, সরকার সমালোচিত হবে বৈষম্য হচ্ছে বলে। আবার, সরকার যদি এক বার করেছে বলে বার বার ক্ষতিপূরণ দেয়, তা হলে এমন ঘটনার সম্ভাবনাও বেড়ে চলবে, যা সামাল দেওয়া অসম্ভব।
তা হলে উপায়? সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর হতেই হবে। লক্ষ করে দেখুন, ইচ্ছাকৃত ভাবেই আমি এমন একটি উদাহরণ নিয়েছি, যেখানে দরিদ্র মানুষটি কোনও ব্যক্তিগত হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে সর্বস্বান্ত হয়েছেন তা নয়। তবু যুক্তিপরম্পরা অনুসরণ করে দেখা যাচ্ছে, সরকারি অর্থে ক্ষতিপূরণের এক অবাঞ্ছিত পরিণতির সম্ভাবনা রয়েছে। এ বার যদি বিষাক্ত চোলাই মদ খাওয়া কিংবা দ্বিগুণ টাকা ফেরত পাওয়ার আকর্ষণে ঝাঁপ দিয়ে ক্ষতিটি হয়, তা হলে তো ক্ষতিপূরণের বিপক্ষে যুক্তিটি আরও জোরালো হয়।
ক্ষতিপূরণের ন্যায্যতার প্রশ্নে কয়েকটি বিষয় একটু বুঝে নিতে হবে, যা ক্ষতির কারণটি বিশ্লেষণ করলেই পাওয়া যাবে। ক্ষতির পিছনে ব্যক্তিমানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত কতটা দায়ী। যদি ক্ষতির মূল কারণটি ব্যক্তিমানুষের নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে হয়, তা হলেই ক্ষতিপূরণ একটা ন্যায্যতা পেতে পারে। এ বার দেখা যাক, সারদায় বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির কতটা দায় তাঁদের, কতটা অন্যের। এ পর্যন্ত পড়ে কেউ যেন ভেবে না বসেন আমি সারদা-কাণ্ডের সমস্ত দায় আমানতকারীদের ওপর চাপাতে চাইছি। ক্ষতিপূরণের জটিল কার্য-কারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে এর যৌক্তিকতা ও ন্যায্যতা খতিয়ে দেখাই এই লেখার উদ্দেশ্য।
আসলে প্রশ্নটা হল লাভ ও ঝুঁকির দ্বন্দ্ব নিয়ে। বেশি লাভ ও কম ক্ষতির দিকে ব্যক্তিমানুষের আকর্ষণ যেন প্রায় নিয়তিনির্দিষ্ট। যে কোনও দু’টি বিকল্পের মধ্যে প্রথমটিতে যদি দ্বিতীয়টির থেকে বেশি লাভ হয় এবং বাকি সব বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে যদি দু’টি বিকল্পই সমান হয়, তা হলে সব্বাই প্রথমটিই বেছে নেবেন। কিন্তু যদি দেখি দু’টি বিকল্পই কোনও না কোনও মানুষ বেছে নিচ্ছেন, তা হলে অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে, বেশি লাভের সঙ্গে এমন কিছু ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে, যা হয়তো কম লাভের বিকল্পটিতে কম। বেশি লাভ ও কম লাভের দু’টি প্রকল্পই বাজারে চালু থাকলে বুঝতে হবে যে বেশি লাভের সঙ্গে ক্ষতির সম্ভাবনাও বেশি, যে ক্ষতি ঝুঁকি রূপে লুকিয়ে আছে, থাকতেই হবে। আর্থিক উপদেষ্টারা পরামর্শ দেন বিনিয়োগকে বেশি-লাভ বেশি-ঝুঁকি এবং কম-লাভ কম-ক্ষতির মধ্যে ভাগাভাগি করে রাখতে। সাধারণ বুদ্ধিও তা-ই বলে। তা হলে এই অবিশ্বাস্য লাভের প্রতিশ্রুতি পেয়ে মুক্তকচ্ছ হয়ে লাফিয়ে পড়ার কারণ কী? অনেকেই অনেক কারণের কথা বলছেন, যদিও সারদা-কাণ্ডের ক্ষেত্রে কোনটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, তা নির্ভুল জানার উপায় নেই। প্রথমত, অনেক দরিদ্র মানুষের ব্যাঙ্ক-ব্যবসার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই, কারণ হয় কাছাকাছি ব্যাঙ্ক নেই অথবা থাকলেও ব্যাঙ্কের সঙ্গে সংযোগ সাধনের প্রক্রিয়াটি এতটাই জটিল ও তাঁদের কাছে এতটাই ভীতিপ্রদ যে, তাঁরা ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলার উৎসাহ পান না, যে সামান্য সঞ্চয় হয়, তা-ই তুলে দেন হাতের কাছে থাকা সারদার এজেন্টের হাতে। অবিশ্বাস? হয়নি, কারণ সারদার সরকার-ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু এ রকম মানুষের সংখ্যা ও আমানতের পরিমাণ কত হবে? আন্দাজ করতে পারি, অধিকাংশ বড় আমানতকারীর নাগালেই ব্যাঙ্ক রয়েছে। প্রসঙ্গত জানা গেল, সোনাগাছিতে নিজস্ব সমবায় থেকে জমানো টাকা তুলে নিয়ে যৌনকর্মীরা সারদায় ঢেলেছেন। অর্থাৎ, অধিকাংশ মানুষের কাছে কম-ঝুঁকি কম-লাভের বিকল্প থাকা সত্ত্বেও তাঁরা সারদায় ঝাঁপ দিয়েছেন।
অবশ্য ঝুঁকির তত্ত্ব বলছে, সব মানুষের ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছা বা ক্ষমতা সমান নয়। কেউ শেয়ার বাজারে লগ্নি করেন, কেউ ব্যাঙ্কের স্থায়ী আমানতে। এই ইচ্ছা বা ক্ষমতা কি ব্যক্তির আয় বা সম্পদের সঙ্গে সম্পর্কিত? সম্পর্ক একটা থাকলেও তেমন জোরালো নয়। তবু সাধারণ ভাবে ধরে নেওয়া হয়, দরিদ্র বা নিম্নবিত্ত মানুষের ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছা বা ক্ষমতা কম, উচ্চবিত্তের তুলনায়। অথচ কী আশ্চর্য! সারদার মতো এমন চরম ঝুঁকিপূর্ণ আমানত প্রকল্পে যাঁরা আকৃষ্ট হয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত, এমনকী হতদরিদ্র। একটি ছোট্ট চটজলদি সমীক্ষা চালাচ্ছিলাম আমার পরিচিত সহকর্মী বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে। প্রথমে জানতে চাই তাঁরা কেউ সারদা বা এ জাতীয় কোনও প্রকল্পে টাকা রেখেছেন কি না। তাঁরা সব্বাই বলেন ‘না’। তার পর জিজ্ঞেস করি, তাঁদের বাড়িতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা কেউ রেখেছেন কি না। সব্বাই বলেন ‘হ্যাঁ’। এমন স্পষ্ট বিভাজন অবাক করে দেওয়ার মতো।
সারদায় ক্ষতিগ্রস্তদের এই শ্রেণি-প্রকৃতিই হয়তো আমাদের বিচলিত করেছে বেশি। তাঁদের হাহাকারে কোনও সংবেদনশীল মানুষই নির্বিকার থাকতে পারেন না। তবু ক্ষতিপূরণের নীতি, যুক্তি ও ন্যায্যতার বিচারে ঠিক নয়। ব্যক্তিমানুষের ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের, যা এড়ানো যায়, তার পরিণতির দায় হয়তো পুরোপুরি ব্যক্তিমানুষের না-ও হতে পারে। তথ্যের অপূর্ণতা কিংবা ভ্রান্ত তথ্যের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাব এ সবের জন্য সরকারকে দায়ী করা যেতে পারে, আর সরকারও তার অপরাধবোধে কিংবা গাফিলতির অস্বস্তিকে চাপা দিতে কিছু একটা করতে চাইতেই পারে। কী, তা আমরা জানি না। তবে ক্ষতিপূরণ যে নয় তা বলা যায়, কারণ তা অন্যায্য। যেখানে বিপর্যয় ব্যক্তিমানুষের নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে, সেখানেই কি সরকার সব সময় পাশে দাঁড়াতে পারে? অর্ধাহার কিংবা অপুষ্টি কি একেবারেই বিদায় নিয়েছে দেশ থেকে, রাজ্য থেকে?
ক্ষতিপূরণের পক্ষেই যেহেতু জনসমর্থন বেশি, অন্তত আশা করব ক্ষতিপূরণের ৫০০ কোটি দার্শনিক জন রল্সের প্রদর্শিত পথে বণ্টিত হবে। কে কত টাকা খুইয়েছেন, তার ভিত্তিতে নয়। যাঁদের ক্ষতি হয়েছে, তাঁদের মধ্যে দরিদ্রতম ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ দিয়ে শুরু করে ধাপে ধাপে উঠতে হবে। অবশ্য বাস্তবে এর প্রয়োগ প্রায় অসম্ভব। দরিদ্রতমকে চিহ্নিত করতেই কালঘাম ছুটে যাবে। তবু ন্যায্যতার প্রশ্নটা স্পষ্ট ভাবে সামনে থাকলে অন্তত বড় রকমের ভুল এড়ানো যায়।

অর্থনীতিবিদ, ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা’র অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.