সারদা সাম্রাজ্য পরিচালনায় সুদীপ্ত সেন তাঁর আট সেনাপতির উপর নির্ভর করতেন। যার পোশাকি নাম ছিল কোর ম্যানেজমেন্ট টিম। দেবযানী ছাড়া আরও সাত জন ছিলেন সেই টিমে। সংস্থার গণেশ উল্টোনোর পর সেই টিম-সুদীপ্তই এখন পুলিশের বড় ভরসা।
গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই সুদীপ্তর সেনানীরা বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটে হাজির হয়ে গোয়েন্দাদের জানিয়ে দিচ্ছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে ‘সেন স্যার’ মিথ্যা কথা বলছেন। পুলিশ এঁদের অনেককেই সারদা মামলায় সাক্ষী করার কথাও ভাবছে।
তদন্তকারী অফিসাররা জানিয়েছেন, সারদা মামলার তদন্তে সবচেয়ে বড় কাজ সংস্থার সম্পদ এবং আমানতকারীদের প্রাপ্যের হিসাব তৈরি করা। কী ভাবে সংস্থা বাজার থেকে টাকা তুলত, কোন খাতে টাকা খরচ হত তা জানার ক্ষেত্রে সহায়তা করছেন টিম সুদীপ্তর এক সদস্য। মানবসম্পদে এমবিএ করা এই ব্যক্তির উপরে সারদা-মালিক এতটাই নির্ভর করতেন যে, তাঁকে সংস্থার ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের প্রধান দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এ ছাড়া প্রতিদিনের টাকা তোলার পর সাফারি সফটওয়্যারে তা এন্ট্রি করা থেকে শুরু করে যাবতীয় হিসেবনিকেশের ভারও ছিল তাঁর উপর। কোম্পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সফটওয়্যারটির মাদার সার্ভার তাঁর হাতেই ছিল। সংস্থায় ডামাডোল শুরু হওয়ার পর সুদীপ্তবাবু তাঁর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের প্রধানকে সন্দেহ করতে থাকেন। পুলিশ জানিয়েছে, মাসখানেক আগে সংস্থা ছেড়েছিলেন ওই ব্যক্তি। এখন সংস্থার হিসেব পরীক্ষার কাজে তিনিই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছে পুলিশকে।
বিধাননগর কমিশনারেটে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে পুলিশকে সাহায্য করছেন সুদীপ্ত সেনের আর এক সৈনিক, যিনি ছিলেন সারদা অ্যাগ্রো প্রোডাক্টের প্রধান। এমবিএ পাশ ওই যুবক সংস্থার শুরুর দিন থেকে সুদীপ্তবাবুর সঙ্গে ছিলেন। এজেন্ট নেটওয়ার্ক গড়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা ছিল তাঁর। সংস্থায় যে ২ লক্ষ ৮৩ হাজার এজেন্ট যুক্ত হয়েছিলেন, তার কৃতিত্বের সিংহভাগই ওই যুবকের। কী ভাবে সারদার ভাবমূর্তি আমানতকারীদের মধ্যে তুলে ধরতে হবে, তা নির্ধারণ করতেন তিনি। গোলমাল শুরুর পরও ‘সেন স্যার’-এর সঙ্গ ছাড়েননি তিনি।
আর এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সারদা রিয়েলটির জেনারেল ম্যানেজার। এমবিএ স্নাতক ওই যুবক সারদায় যোগ দেন গোড়ার দিকে। কিন্তু টাকা তোলার মূল কোম্পানিতে কিছু আর্থিক কেলেঙ্কারি হচ্ছে সন্দেহ করে সুদীপ্তবাবু তাঁকে সরিয়ে দেন। তবে সংস্থা থেকে তাড়িয়ে দেননি। তাঁকে সারদা প্রিন্টিং-পাবলিকেশনের ভার দেওয়া হয়। সারদার অধীনে কাগজগুলির যাবতীয় কাজ সামলাতেন তিনি। সেই সঙ্গে দায়িত্ব ছিল সেলিব্রিটি ম্যানেজমেন্টের। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তিনিই যোগাযোগ রাখতেন বলে পুলিশ জেনেছে। তাঁর কাছ থেকেই এই সংক্রান্ত খবরাখবর সংগ্রহ করছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশকে সেন স্যারের টাকা সরানোর পন্থা বাতলে দিচ্ছেন যিনি, তিনি প্রাক্তন এক গ্যারাজ কর্মী। আর্থিক ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করায় তাঁকে সারাদিনের টাকাপয়সার হিসাব রাখার ভার দেওয়া হয়। সল্টলেকের ডিএন-২৯ অফিস থেকে প্রতিদিন রাতে জমা পড়া টাকা এবং সফটওয়্যার থেকে নেওয়া প্রিন্ট আউট নিয়ে তিনি হাজির হতেন মিডল্যান্ড পার্কে খোদ সুদীপ্ত সেনের কাছে। কোনও শাখা অফিসে গোলমাল হলে বা কোনও জটিল সমস্যা যা একটু অন্য ভাবে সামলাতে হবে সুদীপ্ত সেনের ভরসা ছিলেন শক্তপোক্ত চেহারার এক ব্যক্তি। তিনিও এখন পুলিশকে বহু গোপন তথ্য জোগাচ্ছেন।
এ ছাড়া সারদার সম্পত্তির হিসাব হদিশ করতে কৌশলগত সাহায্য নেওয়া হচ্ছে আরও দুই মহিলা কর্মীর। দুজনেই এমবিএ (ফিনান্স) পাশ করা। যে পরিমাণ টাকা আসত, তা কোথায় রাখা হবে, কাকে কত টাকা দেওয়া হবে, কোথায় খরচ করা হবে ইত্যাদি বিষয় সামলাতেন এই দু’জন। এতটাই গোপনে সেই কাজ হত যে, ব্যাঙ্কিং-অপারেশনের ঘরটির দরজা সব সময় বন্ধ থাকত। উধাও হয়ে যাওয়া সম্পত্তির খোঁজে এই দুই মহিলা পুলিশকে সহযোগিতা করছেন। বিধাননগরের গোয়েন্দাপ্রধান অর্ণব ঘোষ বলেন, “সারদার কর্মীরা খুবই সহায়তা করছেন। সেই কারণেই তদন্তের গতি আশাব্যঞ্জক। আসলে যাঁরা বেতন পাচ্ছিলেন না, তাঁদের আর কী দোষ?” সুদীপ্ত-বাহিনীর অনেকে এখন পুলিশের কাছেই আর্জি জানাচ্ছেন, “স্যার, সারদার নাম শুনে কেউ চাকরি দিচ্ছে না। পারেন আমাদের কিছু একটা হিল্লে করে দিতে?” |