শিল্প-সাম্রাজ্য গড়ার লক্ষ্যে সারা বছরই নতুন নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব জমা পড়ত সুদীপ্ত সেনের কাছে। চোখ বুলিয়ে প্রশংসা করতেন সিএমডি স্যার। তার পরে সব ডিপ-ফ্রিজে চালান করে দিতেন। এই ভাবে তিন বছরে কৃষি, গ্রামীণ অর্থনীতি, মুদ্রণশিল্প ইত্যাদি নিয়ে নানা কিসিমের প্রকল্পের ফাইল স্যারের চেম্বারে জমা হতে দেখেছেন সংস্থার এক কর্মী। পরিণতি, লবডঙ্কা। সেন-সাম্রাজ্যে বেশির ভাগ প্রকল্পই ছিল নামকাওয়াস্তে। পুলিশকে ওই কর্মী জানিয়েছেন, মাসের পর মাস নিস্ফল ফাইলের পাহাড় জমতে দেখে অসহায় লাগত। কর্মীরা অনেকেই আস্তে আস্তে বুঝে গিয়েছিলেন, সুদীপ্তের শিল্প-সৌধ আদতে পুরোটাই ফাঁপা। লাভের জন্য ধৈর্য ধরতে হবে, এমন কোনও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে রুচি নেই তাঁর। |
ম্যাডাম আছেন, স্যার নেই! মিটিংয়ে সাধারণত এমন দৃশ্য বড় একটা দেখা যেত না। কিন্তু বার দুয়েক ম্যাডাম নিজেই কর্মীদের তলব করেছিলেন। সারদা-গোষ্ঠীর ‘উইমেন্স হ্যারাসমেন্ট সেল’-এর বৈঠক। কয়েকটি অভিযোগের খোঁজ-খবর নিতে ওই সেল-এর সঙ্গে মিডল্যান্ড পার্কে বসেন দেবযানী মুখোপাধ্যায়। নিজে অবশ্য কোনও সিদ্ধান্ত নেননি ম্যাডাম। বৈঠকের শেষে বলেন, “শুনলাম, দেখি স্যারকে বলব!” এক মহিলা তাঁকে অনুরোধ করেন নারীদের জন্য ওই বিশেষ ‘সেল’-এর সদস্য হতে। শুনে মৃদু হেসে উঠে যান দেবযানী। |
গভীর রাতে পিক-আওয়ার্সেও মাঝেমধ্যে ফোন বন্ধ করতে বাধ্য হতেন সুদীপ্ত। সেই ফোনটা এলেই সিএমডি-র শরীরের ভাষায় অস্বস্তির ছাপ ফুটে উঠত। কখনও তোতলাতেন, কখনও চেঁচাতেন। বলতেন, “প্লিজ, এখন না! এখন কথা বলা যাবে না!” পাশে বসা দেবযানীর চোখমুখেও অস্বস্তি ফুটে উঠত। সুদীপ্তর ঘনিষ্ঠরা এটুকু শুনেছিলেন, ওই ফোন নাকি আমেরিকা থেকে এক বাঙালি মহিলার। একমাত্র দেবযানী তাঁর পরিচয় জানতেন। এই মার্কিন সূত্রটির বিষয়ে জানতে পেরে এক পুলিশকর্মীর টিপ্পনী, দেখা যাক্, এ বার হয়তো আমেরিকায় যেতে হবে রেড করতে! |
বেজায় ফাঁপরে পড়েছেন বিধাননগর ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানার পুলিশকর্মীরা। থানা-চত্বরে রোজই জমা হচ্ছে বিভিন্ন মডেলের নতুন-নতুন গাড়ি। কে তাদের মালিক? কোন সংস্থা থেকে তাঁদের ভাড়া নেওয়া হয়েছিল? লিখতে লিখতে জেরবার পুলিশ। সারদা-গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থার দফতরে পুলিশি অভিযানের সূত্রে এই গাড়ির বোঝা ঘাড়ে এসে পড়ছে। এক পুলিশ অফিসার তো বলেই ফেললেন, ওরে বাবা, সারদার এত গাড়ি রাখতে গিয়ে সরকারকে না জমি অধিগ্রহণ করতে হয়। |
দিন যে ঘনিয়ে আসছে তা নিজে ভালই বুঝছিলেন সুদীপ্ত সেন। সংস্থার ইন-হাউস পত্রিকা আবিষ্কার-এর পাতা উল্টে অনেকটা তেমনই ইঙ্গিত পেয়েছিলেন সারদার কোনও কোনও কর্মী। ওই পত্রিকার গত ডিসেম্বর সংখ্যায় ‘কর্ণধারের কলম থেকে’ শীর্ষক কলামে সুদীপ্ত লিখেছিলেন, তাঁর আক্ষেপ অনেক কর্মীরই ‘কোম্পানির পরিধি, বিস্তার, কর্মপদ্ধতি’ সম্পর্কে বিশদ ধারণা নেই, যা সারদার উন্নতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তিনি নিজেও অবশ্য স্বীকার করেন, চিট ফান্ড, মাইক্রো ফিনান্স, মানি মার্কেট ইত্যাদি বিষয়ে কর্মীদের তাঁরা ঠিকঠাক তালিম দিতে পারেননি। ওই প্রতিবেদনে এর পরে ‘কোম্পানির কমিনিউটি ডেভলেপমেন্ট’-এর উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি আলোচনা করেছিলেন। পরের মাসেই মাইনে বন্ধ হয়ে যায় সারদা-র কর্মীদের। অনেকেরই মত, শেষবেলায় এজেন্টদের চাঙ্গা করার একটা চেষ্টা করেছিলেন সিএমডি। কিন্তু পাশা উল্টে যায় তার আগেই। বহু তীর্থ ঘুরে দৌড়তে হয় ভূস্বর্গে। |