সঙ্গে ওয়ালেট রাখতেন না ‘সেন স্যার’। কিন্তু ‘ম্যাডাম’কে মাসে হাতখরচা দিতেন এক লক্ষ টাকা। বেতন যে দিন দেওয়া হত, সে দিনই নগদ এক লাখের প্যাকেট চলে আসত দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের টেবিলে। তাঁর বেতন বাবদ আরও এক লাখ অবশ্য ব্যাঙ্কেই জমা পড়ত। আর মালিক সুদীপ্ত সেন? তিনি কোনও বেতন নিতেন না। নিজের জন্য খরচও করতেন না তেমন। যদি কিছু খরচ করতেই হত, সেটা করতেন দেবযানী। এর জন্য সংস্থার টাকা থেকে যত খুশি খরচের একমাত্র অধিকার তাঁরই ছিল। জেরা যত এগোচ্ছে, স্যার-ম্যাডামের রসায়নের এমন অনেক খবরই পাচ্ছেন তদন্তকারীরা।
যেমন তাঁরা জেনেছেন, সারদা মালিকের দু’বেলার খাবার আসত দেবযানীর বাড়ি থেকে। একটি এসি গাড়ি রোজ সল্টলেক থেকে ঢাকুরিয়া যেত খাবার আনতে। সুদীপ্তবাবু কোন দিন কী পরবেন, তা-ও ঠিক করতেন দেবযানী! সারদা মালিকের প্রসাধন সামগ্রী থেকে শুরু করে স্নানঘরের সরঞ্জামও তিনি কিনতেন (যদিও ইদানীং দু’জনের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে)।
এ হেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ দেবযানীই একমাত্র সারদার আর্থিক খুঁটিনাটির আগাগোড়া জানেন বলে মনে করছেন তদন্তকারী অফিসাররা। তাঁরা জানাচ্ছেন, দেবযানীর স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। তাই একটা সময়ে সংস্থা সংক্রান্ত যে কোনও ব্যাপারে তাঁকে মুশকিল আসান মনে করতে শুরু করেছিলেন সুদীপ্ত সেন। ফলে যে কোম্পানিতে আলপিন কেনার জন্যও ‘সিএমডি স্যার’-এর অনুমতি নিতে হত, সেখানে টাকা খরচের ব্যাপারে দেবযানীর ছিল অপার স্বাধীনতা। উল্টো দিকে, ‘ম্যাডাম’-এর ব্যক্তিগত খরচ তো বটেই, তাঁর পরিবারেরও যাবতীয় খরচ বহন করত সারদা সংস্থা। গত বছর দেবযানীর এক বোন যাদবপুরের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে এনআরআই কোটায় ভর্তি হন। তদন্তকারী অফিসারদের দাবি, সেই সময়ে ৫০ লক্ষ টাকারও বেশি ক্যাপিটেশন ফি জুগিয়েছিলেন সুদীপ্ত।
স্পষ্টতই, লাখ টাকা বেতন এবং লাখ টাকা হাত খরচের বাইরেও সারদার সংসার থেকে দেদার আয় করেছেন ১০ হাজার টাকার বেতনে জীবন শুরু করা দেবযানী মুখোপাধ্যায়। চাকরি পাওয়ার বছর দুয়েকের মধ্যেই ঢাকুরিয়ার যে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন, ওই সময় সেটির বাজারদরই ছিল দেড় কোটি টাকার মতো। ফ্ল্যাট সাজাতে খরচ হয় আরও এক কোটির কাছাকাছি। সেই ফ্ল্যাট দেখেছেন, এমন এক প্রতিবেশীর বিস্মিত প্রতিক্রিয়া, “পুরো ফ্ল্যাটটাই সেগুন কাঠ আর বেলজিয়ান গ্লাসে মোড়া। সিলিংয়ে দামি ঝাড়বাতি। পাঁচ-পাঁচটা এয়ারকন্ডিশনার। ভাবা যায়! একেবারে সিনেমার শু্যটিংয়ের কোনও সেট-এ গিয়েছি মনে হচ্ছিল।”
জমকালো ওই ফ্ল্যাট থেকে কয়েক কদম দূরে, স্টেশন রোডে দেবযানীর ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটটার ছবি কিন্তু একেবারেই উল্টো। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সেখানেই গভীর রাত পর্যন্ত অফিসের কাজকর্ম করতেন দেবযানী। রাতের দিকে মাঝেমধ্যেই ওই ফ্ল্যাটে অনেকে আসতেন আর ভোরের দিকে বেরিয়ে যেতেন। বস্তায় ভরে ‘কী সব জিনিস’ নিয়ে আসতেন কেউ-কেউ। এক প্রতিবেশী বললেন, “ঘনিষ্ঠ কেউ ছাড়া ওই ফ্ল্যাটে কাউকে ঢুকতে দিতেন না দেবযানী। এখন সন্দেহ হয়, বস্তায় টাকাপয়সা ভরেই হয়তো ওই ফ্ল্যাটে রাখতেন তিনি।”
কার্যত আসবাবহীন ওই ফ্ল্যাটের দরজায় নেমপ্লেটও লাগাননি দেবযানী। এক আবাসিক বলেন, “দেখা হলেই ওঁকে বলতাম, দরজায় নামটা অন্তত লিখে দিতে। উনি এড়িয়ে যেতেন। কিছুটা সন্দেহ হলেও আমরা কেউ-ই ব্যাপারটা নিয়ে তখন মাথা ঘামাইনি।” এলাকার কয়েক জন সুদের কারবারি অবশ্য দেবযানীর টাকার গন্ধ পেয়ে গিয়েছিলেন। এক বার এলাকার এক মহাজনের কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা ধার নিয়ে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিলেন এক ব্যক্তি। অথৈ জলে পড়ে ওই মহাজন স্থানীয় এক প্রোমোটারের পরামর্শে দেখা করেন দেবযানীর সঙ্গে। স্থানীয় সূত্রের খবর, আইনজীবীর মাধ্যমে ওই মহাজনকে প্রথমে ২০ লক্ষ টাকা পাঠান দেবযানী। তার পর কয়েক দফায় প্রায় কোটির কাছাকাছি। মাসে আড়াই শতাংশ হারে সুদ নিতেন ‘ম্যাডাম’। খবর ছড়াতেই এলাকার অনেক সুদ-কারবারি দেবযানীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। লেনদেন চলত আইনজীবীর মাধ্যমে। মাসের ১০ তারিখের মধ্যে সুদের টাকা আদায় করতেন আইনজীবীরা। লিখিত চুক্তি ছাড়াই টাকা দেওয়া-নেওয়া হত। ঢাকুরিয়া-যাদবপুর এলাকায় এখন দেবযানীর ধার দেওয়া প্রায় ১০ কোটি টাকা বাজারে খাটছে বলেও জানিয়েছেন এক সুদ কারবারি।
শুধু সুদীপ্তই নয়, ঢাকুরিয়ার সুদখোর মহাজনদেরও ‘মুশকিল আসান’ হয়ে উঠেছিলেন দেবযানী!
|