বিরাটি স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে চায়ের দোকান রয়েছে বাবুর। প্রতি দিন রাত ন’টা নাগাদ তাঁর দোকানে বছর তিরিশের এক মহিলা এসে তিরিশ টাকা করে নিয়ে যান। হিসেব তুলে দিয়ে যান বাবুর কাছে থাকা একটি পাসবইয়ে।
বাজার করার ফাঁকেই নিউ ব্যারাকপুরের মাছবিক্রেতা খোকনের দোকানে এসে টাকা নিয়ে যান এক মাঝবয়সী ব্যক্তি। কখনও সকালে না আসতে পারলে সন্ধ্যায় খোকনের বাড়ি থেকেও টাকা নিয়ে আসেন তিনি।
এই ছবিটা বাবু কিংবা খোকনেরই নয়, শহর-মফস্সল-গ্রামের আনাচে কানাচে এ ভাবে টাকা সংগ্রহ করেন অনেকেই। পথেঘাটে তাঁদের পরিচিতি ‘এজেন্ট দাদা’ বা ‘এজেন্ট দিদি’ হিসেবেই। কিন্তু এঁরা কারা?
এই টাকা আদায়কারীরা আসলে বিভিন্ন ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থার এজেন্ট। যাঁদের কাজ সংস্থার দৈনিক জমা প্রকল্প বা ‘ডেলি স্কিমে’ আমানতকারীদের কাছ থেকে রোজ টাকা নিয়ে আসা। প্রবীণদের বক্তব্য, বেশ কয়েক বছর আগে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কেও এমন এজেন্টের দেখা মিলত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাঁরা যেন উবে গিয়েছেন। অনেকে আবার লাভের আশায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এজেন্সি ছেড়ে এই ধরনের আর্থিক সংস্থার এজেন্ট হয়ে গিয়েছেন।
এমনই একটি ঘটনার বিবরণ দিলেন বিরাটি স্টেশনের চায়ের দোকানদার বাবু। তাঁর কথায়, “বছর সাতেক আগে ইউকো ব্যাঙ্কের স্বল্প সঞ্চয়ের এক এজেন্ট এসে তাঁর থেকে টাকা নিতেন। কিন্তু বছর তিনেক আগে থেকেই তিনি আসা বন্ধ করে দেন। এর বছর খানেক পর ওই এজেন্ট দিদি এসে ডেলি স্কিমের কথা বলেন।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেটেখাওয়া মানুষের কথা মাথায় রেখেই আশির দশকের গোড়ায় রাজ্যে অধিকাংশ ব্যাঙ্কই দৈনিক জমা প্রকল্প চালু করেছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রায় সব কটি ব্যাঙ্কই প্রকল্পটি গুটিয়ে নিয়েছে। যার অন্যতম উদাহরণ ইউকো ব্যাঙ্ক। বছর পাঁচেক আগেই তাঁদের দৈনিক জমা প্রকল্প (‘লঘু বচৎ যোজনা) বন্ধ করে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। তবে ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (ইউবিআই) এখনও এই ধরনের প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে।
এ রাজ্যে ইউবিআই পরিচালিত বঙ্গীয় গ্রামীণ বিকাশ ব্যাঙ্কের সাতশোটি শাখায় ‘মাইক্রো এটিএম’ বা ‘আল্ট্রা স্মল ব্যাঙ্কের’ মাধ্যমে ‘সাধ্যানুসার জমা যোজনা প্রকল্পে’র সুযোগ আছে। কিন্তু, তা আশানুরূপ ব্যবসা দিতে পারছে না বলে ব্যাঙ্ক সূত্রের খবর। এই প্রকল্প কত দিন চালানো যাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের মনে। সব জেলায় এখন আর প্রকল্প চালু নেই। রাজ্যে মোট এজেন্টের সংখ্যা ছ’শোর কাছাকাছি।
ইউবিআই-এর এক কর্তার কথায়, “টাকা জমানোর ব্যাপারে গরিবকে উৎসাহিত করার জন্য ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ প্রায় কিছুই করেন না। এটা গরিব মানুষকে চিট ফান্ডের দিকে ঠেলে দেওয়ার অন্যতম বড় একটা কারণ।”
অবশ্য এই ধরনের প্রকল্পের আরও কয়েকটি অসুবিধা উঠে এসেছে ব্যাঙ্ক কর্তাদের কথায়। ইউবিআইয়ের এক পদস্থ অফিসার জানান, আমানতকারীদের কাছ থেকে টাকা ব্যাঙ্কের নিজস্ব কর্মীরা সংগ্রহ করেন না। ব্যাঙ্ককে এজেন্ট নিয়োগ করতে হয়। আমানতকারীকে সুদ ও এজেন্টদের কমিশন দিয়ে প্রকল্পটি থেকে মুনাফা প্রায় হয় না বললেই চলে। ওই প্রকল্প থেকে আমানত সংগ্রহের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য নয়। এজেন্টের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করা হয় বলে প্রক্রিয়াটিতে অনেক ঝুঁকি রয়েছে বলে ব্যাঙ্ক কর্তাদের অভিমত।
ব্যাঙ্ক সূত্রের খবর, প্রতি দিন ন্যূনতম দশ টাকা করে সঞ্চয়ের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। শুরুর দিকে ভাল সাড়া মিললেও পরের দিকে তাতে ভাটা পড়ে। বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্তাদের মতে, প্রকল্প নিয়ে ব্যাঙ্কগুলি যথেষ্ট আগ্রহী না হওয়ার ফলেই মানুষের কাছে ঠিক মতো পৌঁছতে পারেনি। সেই ফাঁকেই বাজার ধরেছে ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলি।
ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির স্বল্প সঞ্চয়ে আমানতকারীরা জানান, ব্যাঙ্কে বা ডাকঘরে গেলে প্রচুর নিয়মের বেড়া পেরোতে হয়। তাঁদের অনেকের কথায়, “আমাদের মতো কম লেখাপড়া জানা লোক অত লেখালেখি করতে পারব না। রোজ দশ-বিশ টাকা জমানোর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিতেও পারব না।” ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থাগুলির এজেন্টরা রোজ এসে দোকান-বাজার-বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে যান। অনেক সময় মেয়াদ শেষে বাড়ি এসে টাকাও দিয়ে গিয়েছেন তাঁরা।
ব্যাঙ্ককর্মী সংগঠনগুলির মতে, কেন্দ্রের ব্যাঙ্কিং নীতিও এই অবস্থার জন্য দায়ী। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই ধরনের প্রকল্পে সুদের হার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে (ইউবিআই-এর এই প্রকল্পে সুদের হার বার্ষিক তিন শতাংশ)। তার কয়েক গুণ সুদ দিচ্ছে ভুঁইফোঁড়রা। সেই লোভ সামলানো অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সর্বভারতীয় সম্পাদক সুদীপ্ত সাহারায় বলেন, “এক দিকে লেখালেখির ঝক্কি, অন্য দিকে ভুঁইফোঁড় সংস্থার বেশি সুদ পাওয়ার লোভ। সব মিলিয়েই প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন খেটেখাওয়া মানুষ।”
রয়েছে ব্যাঙ্কগুলির পরিকাঠামোগত ত্রুটিও। ব্যাঙ্ক সূত্রের খবর, ক’বছর আগে থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি ‘কোর ব্যাঙ্কিং সলিউশন’ (সিবিএস) ব্যবস্থা চালু করে। সিবিএস ব্যবস্থার জন্য চাই কম্পিউটার। শহর-মফস্সলের শাখাগুলি পুরো কম্পিউটারচালিত হলেও গ্রামে এখনও তা চালু করা যায়নি। ফলে সেখানে দৈনিক প্রকল্প জনপ্রিয় হলেও তা কার্যকর করা যাচ্ছে না। রয়েছে কর্মীর অভাবও। ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার নেতা ধীশঙ্কর সেনের মতে, কর্মীর অভাবে দৈনিক প্রকল্প চালু রাখা তো দূর অস্ত, দৈনন্দিন কাজই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তা হলে কি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি দৈনিক প্রকল্প থেকে মুখ ঘুরিয়েই থাকবে? এখনও পর্যন্ত তেমনটাই মনে করছেন ব্যাঙ্ক-কর্তারা। নতুন করে ব্যাঙ্কিং পরিষেবার রূপরেখার জন্য গঠিত ‘খাণ্ডেলওয়াল কমিটি’ ২০১০-১১ সালে যে সুপারিশ করেছে তা কার্যকর হলে গ্রামীণ ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের পরিষেবা আরওই সঙ্কুচিত হবে বলে মনে করে ইউনাইটেড ফোরাম অব ব্যাঙ্ক ইউনিয়ন।
|