বিতর্কের মুখে পড়ে ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থা নিয়ন্ত্রণে বিল নিয়ে নতুন আশ্বাস দিল রাজ্য সরকার। এবং তাতেও আবার দেখা দিল পাল্টা প্রশ্ন!
বাম আমলে পাশ-হওয়া বিল প্রত্যাহার করে নিয়ে বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনে আগামী মঙ্গলবার ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থা নিয়ন্ত্রণে নতুন বিল (দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রোটেকশন অফ ইন্টারেস্ট অফ ডিপোজিটর্স ইন ফিনান্সিয়াল এস্টাব্লিশমেন্ট্স বিল, ২০১৩) আনছে রাজ্য সরকার। তার প্রস্তুতি হিসাবে শুক্রবার বিধানসভায় সর্বদল বৈঠকে সরকার পক্ষ আশ্বাস দিয়েছে, বিলটিতে পূর্বপ্রয়োগের (রেট্রোস্পেকটিভ) সংস্থান রাখার চেষ্টা হচ্ছে। একান্তই বিলে তেমন কিছু না করা গেলে বিলের উপরে বিধি (রুল্স) প্রণয়নের সময় ওই সংস্থান অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কিন্তু সরকারের এই বক্তব্য শুনে দুই বিরোধী পক্ষ বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস সর্বদল বৈঠকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, এমন বিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিধানসভায় পাশ হয়ে গেলেও আদালতে চ্যালেঞ্জ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তাতে বিলের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে!
বিরোধীদের অভিযোগ, নতুন বিল এনে আসলে সারদা-কাণ্ডকেই আড়াল করতে চাইছে রাজ্য সরকার। কারণ, রাষ্ট্রপতির সম্মতির পরে নতুন বিল যখন (বিল পাশের দিন থেকে) কার্যকর হবে, তার আওতায় সারদা-কাণ্ড পড়বে না। বাম আমলে ২০০৯ সালে পাশ হওয়া বিলটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে বলবৎ করতে পারলে সারদা-কাণ্ডের বিচার ওই আইন বলে সম্ভব হত। এই বিতর্কের মুখেই এ দিন সরকার পক্ষ বিরোধীদের বলেছে, শুধু সারদাই নয়, অতীতের বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিভিন্ন জালিয়াতিই তদন্ত করে দেখা হবে। বিলে তেমন সংস্থানই (রেট্রোস্পেকটিভ) রাখা হবে।
সর্বদল বৈঠকের পরে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমরা আগের চেয়ে আরও বজ্রকঠোর বিল আনব! নতুন বিলটা যত দূর বুঝেছি, সারদা কেন, কোনও গোষ্ঠীই ছাড় পাবে না। কমিশন অফ এনক্যোয়ারি অ্যাক্ট-এ যে কমিশন হয়েছে, সেখানেই সকলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সংস্থান বিলে থাকা উচিত। এখনকার সারদা হোক, বা ১৯৮০ সালের কোনও গোষ্ঠী, কাউকে ছাড়া হবে না!” পার্থবাবুর আরও মন্তব্য, “বিরোধীরা বলছেন, সারদা যেন ছাড় না পায়। আমরা বলেছি, আপনারা যেন ছাড় না পান!” স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছেন, “পূর্বপ্রয়োগের সংস্থান বিলে থাকলে তা করা যেতেই পারে। দরকারে বিধিতেও তা রাখা যায়।” |
এরই পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশা, খুব দ্রুত নতুন বিলটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়ে কার্যকর হবে। টাউন হলে মন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী জানান, ২০০৯-এর বিলটি রাজ্যপালের মাধ্যমে তাঁরা ফেরত পেয়েছেন এ দিনই। তার অল্প ক্ষণের মধ্যেই নতুন খসড়া বিলে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সইয়ের খবরও এসেছে। রাজ্যপাল কয়েক দিনের জন্য বাইরে যাবেন। বিধানসভায় ৩০ তারিখ বিলটি আসবে। আর রাজ্যপাল দিল্লি ফিরবেন ৫ মে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “সে দিনই রাজ্যের অর্থমন্ত্রী এবং মুখ্যসচিব দিল্লিতেই ওঁকে দিয়ে বিল সই করিয়ে কেন্দ্রের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে দেবেন। যত তাড়াতাড়ি বিল পাশ হবে, তত দ্রুত আমরা এই সব সংস্থার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ফেরত দিতে পারব সাধারণ মানুষকে।”
বাম আমলের দিকে ইঙ্গিত করে মুখ্যমন্ত্রীর আক্ষেপ, “২০০৩ থেকে ২০১৩, দশ বছর লেগে গেল আইন করতে! সঞ্চয়িতার সময়েই (আটের দশকের গোড়ায়) যদি আইন করত, তা হলে এখন এত মানুষ বিপদে পড়তেন না।” তবে সারদা-
কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি মমতার আশ্বাস, “আতঙ্কিত হবেন না! ঝড় এসেছে। সেখান থেকে বাঁচতে হবে। আমাদের সরকার আছে বলে মানুষ বেঁচে যাবে। ভেসে যাবে না!”
কিন্তু সরকারের দাবিমতো পূর্বপ্রয়োগের সংস্থান নতুন বিলে সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম। তাঁর যুক্তি, “নতুন কোনও আইনে পুরনো ফৌজদারি অপরাধের বিচার করা যায় না। সেটা সংবিধান এবং ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির বিরোধী।” প্রাক্তন স্পিকার জানাচ্ছেন, বিধানসভায় এর আগে জমি সংক্রান্ত একটি বিলে পূর্বপ্রয়োগের সংস্থান রাখা হয়েছিল। কিন্তু আর্থিক জালিয়াতির মতো ফৌজদারি অপরাধে যথেচ্ছ পূর্বপ্রয়োগ (‘ব্ল্যাঙ্কেট রেট্রোস্পেকটিভ’) সম্ভব নয়।
এই সূত্রেই কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, “রাষ্ট্রপতির বক্তব্য-সহ পুরনো বিলটা আরও শক্তিশালী করে সংশোধন করে নিলেই সহজতর পথ হত। সরকার যে ভাবে নতুন বিল আনতে চাইছে, সেটা আবার আইনি জটিলতায় আটকে যেতে পারে। সারদা-কাণ্ডে অপরাধীরা সেই ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে পারে!”
সর্বদল বৈঠক সেরে বেরিয়ে সিপিএম বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী আনিসুর রহমানও একই সুরে বলেছেন, “এই বিল আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়ে যেতে পারে। তাতে আরও দেরি হবে এবং সারদারই স্বার্থরক্ষা হবে!” প্রসঙ্গত, বিলের প্রতিলিপি আজ, শনিবার বিধানসভার দফতর খোলা রেখে বিধায়কদের বিলি করার কথা।
|