সারদা গোষ্ঠীর কাজকর্ম নিয়ে মহাকরণের মাথাদের ‘অজ্ঞতা’র দাবি নস্যাৎ করে দিচ্ছে রাজ্যেরই মানবাধিকার কমিশন!
সারদা-কাণ্ডের পর থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য দাবি করে আসছেন যে, ওই সংস্থার টাকা তোলার ব্যবসা সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানতেন না, সংস্থাটি নিছক বাড়ি-জমির ব্যবসা করে বলে তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু কমিশনের দাবি, সারদা গোষ্ঠী-সহ একাধিক ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার কাজ-কারবার সম্পর্কে তারা মহাকরণকে সতর্ক করে দিয়েছিল এ মাসের গোড়াতেই। সারদা-সহ এমন পাঁচটি সংস্থার কাজকর্ম সম্পর্কে সরকার যাতে তদন্ত করিয়ে চার সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দেয়, সে জন্য রাজ্যের অর্থ-সচিবকে চিঠিও পাঠানো হয়েছিল। সেটা কবে?
কমিশন-সূত্রের খবর: একটি অভিযোগের ভিত্তিতে তারা সুপারিশটি করেছিল গত ১৫ মার্চ। সেটি অর্থ-সচিবের কাছে পৌঁছায় কুড়ি দিন পরে, ৪ এপ্রিলে। প্রসঙ্গত, এপ্রিলের ১০ তারিখে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়েছিলেন সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের কর্তাদের প্রশ্ন: যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সঞ্চয় আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগ সামনে আসছে, সেখানে নির্দিষ্ট কিছু সংস্থা সম্পর্কে আগাম হুঁশিয়ারি পাওয়া সত্ত্বেও অর্থ দফতর কেন নড়েচড়ে বসল না?
এর বিশেষ সদুত্তর সরকারি তরফে মেলেনি। যা আরও প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কমিশনের এক কর্তা শুক্রবার বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রীরা দাবি করছেন, সারদার কাজকর্ম সম্পর্কে ওঁরা কিছুই জানেন না! অথচ আমরা সারদার নাম করে রাজ্যকে চিঠি দিয়েছিলাম। তা হলে চিঠিটা কোথায় গেল? ফেলে দিয়েছিল? নাকি সচিবেরা মুখ্যমন্ত্রীকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানান না?”
কী বলছেন অর্থ-সচিব?
অর্থ-সচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী এ দিন প্রশ্নটি শুনে ফোন কেটে দেন। তবে অর্থ দফতরের আর এক অফিসার জানান, “চিঠি আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তরফে তদন্ত শুরুর সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়নি।” ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’টি কে, তিনি তা বলতে চাননি। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের প্রতিক্রিয়া, “ব্যাপারটা নিয়ে আমার কোনও ধারণাই নেই!”
কমিশনই বা আচমকা সরকারকে সতর্ক করতে গেল কেন? কমিশনের যুগ্মসচিব সুজয় হালদার এ দিন জানান, গত ১৫ জানুয়ারি বারাসতের নবপল্লির বাসিন্দা জনৈক রণেন প্রধানের লেখা অভিযোগপত্র কমিশনে আসে। সঙ্গে বেশ কিছু কাগজপত্র ছিল। ওই ব্যক্তি তাতে সারদা-সহ পাঁচটি সংস্থার নাম উল্লেখ করে অভিযোগ করেছিলেন, ওগুলো সব চিটফান্ড, তাদের কাজকর্মে অল্প দিনের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ বিপদে পড়তে পারেন। কমিশনের দুই সদস্য প্রাক্তন বিচারপতি নারায়ণচন্দ্র শীল ও রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব সৌরীন্দ্রনাথ রায়কে বিষয়টি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁরা অভিযোগ যাচাই করে সেটিকে ‘যথেষ্ট গুরুতর’ আখ্যা দেন। চার সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত-রিপোর্ট চেয়ে অর্থ-সচিবকে চিঠি দেয় কমিশন।
সচিবের জবাব আসেনি, চিঠিও নয়। তার আগেই সারদা-কাণ্ড শোরগোল ফেলে দিয়েছে। কমিশনের একটি মহল অবশ্য বলছে, এর আগে রাজ্যের সঙ্গে একাধিক বিষয়ে কমিশনের সংঘাত বেঁধেছে। নাম না-করে কমিশনের চেয়ারম্যানের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। এর পরে কমিশনের কোনও সুপারিশ এলে তা কতটা মানা হবে, তা নিয়ে আমলারা ধন্দে রয়েছেন বলে এই মহলের অভিমত।
ফলে জলে গিয়েছে হুঁশিয়ারি-চিঠিও। আর এ হেন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এ দিন রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, “কী আর বলব! আমরা বিপদ আঁচ করেছিলাম বলেই সরকারকে সব জানানো হয়েছিল। কারণ, লক্ষ-লক্ষ গরিব মানুষের ভবিষ্যৎ এর সঙ্গে জড়িয়ে।” |