সারদা-কেলেঙ্কারি ঘিরে দলের মধ্যেই ঝড়ের মুখে মুখ্যমন্ত্রীর কোর্টে বল ঠেলে দিলেন কুণাল ঘোষ। শুক্রবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়ে ওই তৃণমূল সাংসদ বললেন, “আপনি নির্দেশ দিলে যে কোনও মুহূর্তে রাজ্যসভার সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিতেও আমি প্রস্তুত।”
সারদা-কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েক দিন ধরে সংস্থার প্রাক্তন গ্রুপ মিডিয়া সিইও কুণালের নাম আলোচনার শীর্ষে। তাঁর বিরুদ্ধে ‘দুষ্কৃতী নিয়ে গিয়ে ভয় দেখিয়ে’ নামমাত্র টাকায় ‘চ্যানেল টেন’ বিক্রি করে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টির অভিযোগ করেছেন গ্রেফতার হওয়া সারদা মালিক সুদীপ্ত সেন। সিবিআই-কে লেখা সেই অভিযোগপত্র এফআইআর হিসেবে নেওয়ার আর্জিও জানিয়েছেন তিনি। সারদার আমানত প্রকল্পে কুণালের ভূমিকা নিয়েও অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহলে। পাশাপাশি, বৃহস্পতিবার রাতে পার্ক স্ট্রিট থানায় কুণালের বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় অভিযোগ দায়ের করেছেন ‘চ্যানেল টেন’-এর কর্মীরা এই অবস্থায় তাঁর জন্য দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে কুণালকে দল থেকে বহিষ্কার করার দাবি জানিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী-সহ তৃণমূলের একাধিক সাংসদ। কুণালের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেও মুখ খুলেছেন দলের অনেকে। সেই আক্রমণের মুখে শুক্রবার দলনেত্রীকে হাতে লেখা সাড়ে পাঁচ পাতার চিঠি পাঠিয়েছেন কুণাল। সারদা গোষ্ঠীতে তাঁর অবস্থান ও অধিকার নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশ্যে তিনি যা যা বলেছেন, চিঠিতে সে সব কথাই মমতাকে জানিয়ে তিনি লিখেছেন, “আমি কখনও সারদা গোষ্ঠীর মিডিয়া ছাড়া অন্য কোনও শাখায় জড়িত ছিলাম না। অন্য কোনও ব্যবসার কোনও সেমিনার, সম্মেলন, প্রতিনিধি বৈঠকে এক দিনও যাইনি।” |
চিঠিতে তাঁর আরও দাবি, “সাংসদ হিসাবে আমি কোনও ভাবে কোনও ক্ষমতা বা সম্পর্ক ব্যবহার/অপব্যবহার করিনি। নিজের অপরাধ ঢাকতে সুদীপ্ত সেন নানা চতুরতার আশ্রয় নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন।” মমতাকে তিনি জানিয়েছেন, দলকে এই ঘটনায় কুৎসামূলক ভাবে জড়ানো হচ্ছে। তাঁর বক্তব্য না শুনে, তৃণমূল কংগ্রেসকে একতরফা ভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে।
এর পরই তিনি লিখেছেন, “মাননীয়া নেত্রী, এই পরিস্থিতিতে যে কোনও তদন্তে সহযোগিতা করতে আমি প্রস্তুত। তদন্তের মুখোমুখি হতেও আমি প্রস্তুত।” জানিয়েছেন, যে হেতু ‘বিতর্ক এবং আক্রমণ’ চলছে তাই নেত্রীর নির্দেশ পেলেই তিনি রাজ্যসভার সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিতে পারেন।
তবে তদন্তে কেউ দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগে দলীয় নেতৃত্ব যে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছেন না, তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। বুধবার সারদা-কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তহবিল গঠন করার কথা ঘোষণা করার সময়ই তিনি বলেছিলেন, “এক জন সাংবাদিককে টার্গেট করে একতরফা আক্রমণ শানানো হচ্ছে। একটা চক্রান্ত চলছে। আমি এখনও বলছি, কোনও এমপি চিট ফান্ড মামলায় জড়িত হলে, তার শাস্তি হবেই।”
এ দিন কুণালের বিরুদ্ধে ‘চ্যানেল টেন’-এর কর্মীদের দায়ের করা অভিযোগকেও গুরুত্ব দিতে চাননি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। তিনি বলেন, “আইনগত ভাবে চ্যানেল টেন-এর মালিক তো এখনও সুদীপ্ত সেন। ও (কুণাল) তো মাইনে দিত না। কুণালের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে কী হবে? ও তো ওখানে চাকরি করত। মাইনে দেওয়ার মালিককে ধরতে হবে।” |
যদিও কুণালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না-হলে আখেরে দলের ভাবমূর্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছে তৃণমূলের একটা বড় অংশ। পঞ্চায়েত ভোটের আগে সারদা-কাণ্ডের সঙ্গে দলের নাম যে ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে তাতে তাঁরা উদ্বিগ্ন। আর কুণালের নামই যে হেতু সারদার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল এবং তাঁর বিরুদ্ধেই অভিযোগের আঙুল উঠেছে, সে হেতু কুণালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই দলের ভাবমূর্তি খানিকটা মেরামত হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। দলীয় বৈঠকে সেই দাবি তুলেওছেন একাধিক তৃণমূল সাংসদ। দলের এক বর্ষীয়ান নেতা এ দিন বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীকে কুণালের চিঠি লেখাটা নেহাতই লোক দেখানো। ওর যদি ইস্তফা দেওয়ারই থাকত, তা হলে রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি পাঠানো উচিত ছিল।” ফলে কুণাল মুখ্যমন্ত্রীর কোর্টে বল ঠেললেও দলের অন্দরে তাঁর উপর চাপ বজায় থাকছেই।
এ দিকে, ‘চ্যানেল টেন’-এর কর্মীদের দায়ের করা অভিযোগে কুণাল ছাড়াও সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন, সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট সোমনাথ দত্ত-সহ চ্যানেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত চার আধিকারিকের নাম রয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ, ভয় দেখানো-সহ ৭টি ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে। কুণালের মতো সোমনাথেরও দাবি, “সংস্থার কোনও নীতি নির্ধারণে আমার ভূমিকা ছিল না।”
বকেয়া বেতন-সহ বেশ কয়েকটি দাবিতে এ দিন সকাল থেকে ‘চ্যানেল টেন’-এর অফিসে বিক্ষোভ দেখান চ্যানেলের কর্মীরা। সংস্থার আধিকারিকদের ঘিরে ধরে প্রায় তিন ঘণ্টা ওই বিক্ষোভ চলে। শহরের আরও কয়েকটি স্থানেও সারদার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায় এজেন্ট, আমানতকারী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এ দিন ভবানীপুর থানায় কুণাল ঘোষ ও সুদীপ্ত সেনদের বিরুদ্ধে আরও একটি অভিযোগ দায়ের করেন বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘বেঙ্গল পোস্ট’ ও ‘সকালবেলা’ নামের দু’টি সংবাদপত্রের কর্মীরা।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “প্রয়োজনে অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
|
কোটি-ক্লাব |
|
*সব হিসেব বছরে |
|