|
|
|
|
তৃণমূল সাংসদের নামে সারদা মালিকের
ফৌজদারি অভিযোগ, বিড়ম্বনায় দল
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের কাছে লিখিত ভাবে কার্যত ফৌজদারি অভিযোগ জানিয়েছেন সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন।
সুদীপ্তবাবুর অভিযোগ, মোট ৩০ কোটি টাকায় কেনা ‘চ্যানেল ১০’ তাঁকে মাত্র ৫৫ লক্ষ টাকায় বিক্রি করার জন্য দুষ্কৃতীদের নিয়ে গিয়ে জোর করে চাপ দিয়ে চুক্তিপত্রে সই করিয়ে নিয়েছেন কুণাল। কবে এই চুক্তি হয়, সুদীপ্তবাবুর চিঠিতে তা স্পষ্ট বলা হয়নি। তবে ২০১০ এর ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১২ সালের ৩১ মে পর্যন্ত সারদার মালিকানাধীন ‘চ্যানেল ১০’-এর সঙ্গে ‘সংবাদ প্রতিদিন’ কাগজের সম্পাদকীয় আদানপ্রদানের চুক্তি ছিল বলে জানিয়েছেন ওই সংবাদপত্রের সম্পাদক ও তৃণমূলের আর এক সাংসদ সৃঞ্জয় বসু। যার অর্থ, সুদীপ্তবাবুর অভিযোগ সঠিক হলে, কুণাল তা ঘটিয়েছেন এই সময়ের পরে। |
সিবিআইয়ের কাছে লিখিত অভিযোগ। বিস্তারিত...
|
এই অবস্থায় এক জন দলীয় সাংসদের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের কাছে লিখিত ভাবে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের (সারদা মালিক তাঁর চিঠিটিকে এফআইআর হিসাবে গণ্য করার আর্জি জানিয়েছেন) হওয়ার পর তৃণমূল নেতৃত্বের বিড়ম্বনা আরও বেড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও বলে রেখেছেন, তদন্তে কেউ দোষী প্রমাণ হলে ‘আইন আইনের পথে চলবে’। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কুণালের বিরুদ্ধে ওঠা কোনও অভিযোগকেই সে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এ বার পরিস্থিতি সামলাতে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় সারদা কাণ্ডে দল ও ব্যক্তিকে আলাদা করার চেষ্টায় নেমেছেন। এ দিন তিনি বলেন, “দল হিসাবে তৃণমূল সারদা-কাণ্ডে যুক্ত নয়। অপরাধ প্রমাণ হলে তার দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির।” পার্থবাবুর প্রশ্ন, “সারদা গোষ্ঠী কি আগে চিঠি দিয়ে বলেছিল, এক্স, ওয়াই, জেড তাঁর কাছ থেকে অর্থ নিচ্ছেন? বলেননি কেন?”
সিবিআইকে লেখা ১৮ পাতা চিঠির ৭-এর পাতায় কুণাল ও সৃঞ্জয়ের বিরুদ্ধে সুদীপ্তবাবুর অভিযোগ, ‘সংবাদ প্রতিদিন রোজ আমাকে আক্রমণ শুরু করে। কুণাল ঘোষের নেতৃত্বে এটা চলতে থাকে। রাজ্যের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের একটি বৈঠকে যোগ দেওয়ার পরই সারদার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন তিনি। সংবাদমাধ্যমের এই আক্রমণের সামনে অসহায় হয়ে পড়ি। আমি সংবাদপত্রের ব্যবসায় যোগ দেওয়ার কথা চিন্তা করি। ওই সময়ে জেনাইটিসের চেয়ারম্যান শান্তনু ঘোষ আমার কাছে ইন্দ্রজিৎ চন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। এক জন ফ্রিলান্স সাংবাদিক গৌতম বিশ্বাসও ছিলেন। ‘চ্যানেল ১০’ নামে একটি আঞ্চলিক নিউজ চ্যানেল তাঁরা আমাকে কিনতে বলেন। সেখান থেকেই আমার ভুলের শুরু। ২৪ কোটি টাকা এবং লুকনো খরচ বাবদ আরও ৬ কোটির বোঝা নিয়ে আমি চ্যানেলটি কিনে নিতে রাজি হই। অধিকাংশ লেনদেন ছিল চেকের মারফত।’
‘চ্যানেল ১০’ এর আদি মালিক শান্তনুবাবু অবশ্য এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ২০০৯ সালের গোড়ায় ‘চ্যানেল ১০’ তৈরি হয়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুদীপ্তবাবুকে পরিচালন, ডাইরেক্টরশিপ, শেয়ার হোল্ডিং-সহ গোটা সংস্থাটাই বিক্রি করে দেওয়া হয় ১৬ কোটি টাকায়। পুরো লেনদেনটাই হয় চেকের মারফৎ।
চিঠিতে সুদীপ্তবাবুর দাবি, এর কিছু দিনের মধ্যেই ‘প্রতিদিন’-এর পক্ষে কুণাল ঘোষ এবং সৃঞ্জয় বসু তাঁর কাছে যান। তিনি লিখেছেন, ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে প্রতি মাসে ৬০ লক্ষ এবং চ্যানেলের সিইও হিসাবে কুণাল ঘোষকে প্রতি মাসে ১৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়ার চুক্তি হয়। সৃঞ্জয়বাবুর দাবি অনুযায়ী এটা ছিল ‘সম্পাদকীয় বিষয়’ সরবরাহের চুক্তি। এ ছাড়া চ্যানেলের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর হিসাবে মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গেও ২০ লক্ষ টাকার চুক্তি হয়।
এর পরের পর্বেই কুণালের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ জানিয়ে সুদীপ্তবাবু লিখেছেন, ‘৩০ কোটি টাকা খরচ করেছিলাম ‘চ্যানেল ১০’ কিনতে। আর চ্যানেলের ব্র্যান্ডিং, বিজ্ঞাপন, পরিকাঠামো উন্নয়ন, কর্মীদের বেতন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং আগের ঋণ মেটানোর জন্য খরচ করেছিলাম ৫০ কোটি টাকা। এ সব সত্ত্বেও কুণাল ঘোষ কয়েক জন দুষ্কৃতী নিয়ে ডিএন-২৯, সল্টলেকের সেক্টর ফাইভ-এর তিন তলায় আমার অফিসে এসে পড়ে কিছু কাগজপত্র, চিঠি ও একটি চুক্তিপত্রে সই করতে আমাকে বাধ্য করেন। ওঁরা চলে যাওয়ার পরে আমি ওই সব কাগজপত্র পড়ে দেখি যে, মাত্র ৫৫ লক্ষ টাকায় আমি ‘চ্যানেল ১০’ বিক্রি করে দিয়েছি।’ কাকে বিক্রি করা হয়েছে সে কথা সুদীপ্তবাবু চিঠিতে লেখেননি। তবে রাইস গোষ্ঠীর কর্ণধার সমিত রায় আগেই জানিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে সুদীপ্ত সেনের ওই চ্যানেল নিয়ে একটি সমঝোতা পত্র (মউ) স্বাক্ষর হয়েছিল, যা তিনি পরে বাতিল করে দিয়েছেন। অর্থাৎ ‘চ্যানেল ১০’ এর মালিকানা এখন রাইস গোষ্ঠীর হাতে নেই। এখন তা হলে ওই টিভি চ্যানেলের মালিকানা কার, কার টাকায় কী ভাবে এখনও সেই চ্যানেলটি চলছে, সে সব প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হয়নি। সাংসদ কুণালবাবুকে তাঁর একাধিক মোবাইলের কোনওটিতেই পাওয়া যায়নি। সৃঞ্জয়বাবু বলেছেন, ২০১২-র ৩১ মে-র পর থেকে তিনি আর ওই চ্যানেলের বিষয়ে কিছু জানেন না। কুণাল আগেই জানিয়েছেন, “দলের অনুমতি ছাড়া আমি কিছু বলব না। তবে চিঠিতে অনেক মিথ্যা কথা আছে।”
অসমের এক চ্যানেলের মালকিন, কংগ্রেস নেতা মাতঙ্গ সিংহের প্রাক্তন স্ত্রী মনোরঞ্জনা সিংহ তাঁর কাছ থেকে ২৫ কোটি টাকা নিয়েছেন বলে সুদীপ্ত চিঠিতে অভিযোগ করেছেন। চিঠি অনুযায়ী, মনোরঞ্জনা ও তাঁর আইনজীবী নলিনী চিদম্বরম মনোরঞ্জনার চ্যানেলে ৪২ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য সুদীপ্তকে চাপ দিচ্ছিলেন। চিঠিতে অভিযোগ, মনোরঞ্জনা লোভ দেখান, নলিনী ও তাঁর স্বামী কেন্দ্রে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম সারদার পাশে দাঁড়ালে ব্যবসার উন্নতি অবধারিত। মনোরঞ্জনা অবশ্য টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি।” নলিনীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে দাবি করা হয়, সারদা মালিক তাঁ র বিরুদ্ধে চাপ দেওয়ার যে অভিযোগ এনেছেন, তা মিথ্যা। তিনি বরং ওই চ্যানেলকে, সারদার টাকা না নিতেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। নলিনীকে ১ কোটি টাকা দেওয়ার যে অভিযোগ সুদীপ্ত তুলেছেন, তার জবাবে ওই সূত্র বলে, নলিনীর মতো অভিজ্ঞ আইনজীবীর পারিশ্রমিক হিসাবে ওই টাকা খুব বেশি কিছু নয়।
সারদা গোষ্ঠীর বাংলা সংবাদপত্রের অসমের প্রকাশক দীবন ডেকা অভিযোগ তুলেছিলেন, অসমের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার সঙ্গে টাউন হলে সুদীপ্তবাবুর বৈঠকের সাক্ষী ছিলেন তিনি নিজে। হিমন্ত বলেন, “সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে ১৯-২০ মাস আগে আমার এক বারই দেখা হয়েছিল। তা টাউন হলে না আমার দফতরে, তা মনে নেই। তিনি আমায় বলেছিলেন ইংরাজি সংবাদপত্র প্রকাশ করতে চান। আমি যেন উদ্বোধন করি। আমি জানাই, এ কাজ কোনও সাহিত্যিককে দিয়ে করানোই ভাল। পরে তাঁরা আমায় আমন্ত্রণও জানাননি। পরে আর দেখাও হয়নি।”
সুদীপ্তবাবুর অভিযোগ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, এই অর্থনৈতিক অপরাধের সঙ্গে যাঁরাই জড়িত থাকবেন, তাঁদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। লক্ষ লক্ষ আমানতকারীর দুর্দশা-দুর্ভোগের পাশে থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা করবে। রাজ্যে ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নিকারী সংস্থার রমরমা নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারকেই এ দিন ফের দুষেছেন পার্থবাবু। তিনি বলেন, “সেবি এখন ব্যবস্থা নিচ্ছে। এটা তারা আগে নেয়নি কেন? বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকলে আমানতকারীদের দুর্ভোগের কথা জানাই যেত না। সরকার বদল হয়েছে বলেই তা প্রকাশ্যে এসেছে।”
সারদা গোষ্ঠীর সব সংস্থার সম্পত্তি কেন আটক করে তদন্ত কমিশনের আওতায় আনা হবে না, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, “তদন্ত কমিশনের বিচার্য বিষয় কী ঠিক করা হয়েছে, তার মধ্যে যাচ্ছি না। কিন্তু যে প্রতারিত মানুষগুলোর জন্য এত সহমর্মিতার কথা সরকার বলছে, তাদের আত্মসাৎ হওয়া টাকা কোথাও না কোথাও বিনিয়োগ হয়েছে। সেই পূর্ণাঙ্গ তালিকাটা দেখা দরকার। সারদা গোষ্ঠীর বিভিন্ন শাখায় যত ব্যবসা আছে, সব ক’টির সম্পত্তি আটক করা দরকার, যাতে তা থেকে আমানতকারীদের টাকা ফেরানোর কিছু ব্যবস্থা করা যায়।” তাঁর আরও মন্তব্য, “বিভিন্ন কাগজ, একাধিক টিভি চ্যানেল কিংবা মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা অনেক ছবি সবই এখনও সারদা গোষ্ঠীর সম্পত্তি! কারণ, তাঁরা এগুলি কিনেছিলেন।” সেলিমের প্রশ্ন, “সেগুলিই বা কেন নিলামে তুলে আমানতকারীদের পাওনা মেটানো হবে না?”
|
থানায় নালিশ
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
এ বার থানায় অভিযোগ দায়ের হল সাংসদ কুণাল ঘোষের বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার রাতে পার্ক স্ট্রিট থানায় সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের পাশাপাশি কুণাল ঘোষ-সহ সাত জনের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করেন বেসরকারি টিভি সংস্থা চ্যানেল টেনের মূল সংস্থা বেঙ্গল মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের কর্তব্যরত কর্মীরা। কর্মীদের অভিযোগ, কুণাল ঘোষ ছিলেন ওই সংস্থার সিইও। এর আগে সারদা গোষ্ঠীর অন্য একটি চ্যানেলের পক্ষ থেকে সুদীপ্ত সেনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয় বিধাননগর সিটি পুলিশের কাছে। বৃহস্পতিবার রাতে থানায় দায়ের করা অভিযোগে কর্মীদের পক্ষ বলা হয়েছে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরেই বেতন পাচ্ছেন না। |
|
|
|
|
|