মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সারদা-কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তহবিল তৈরি করতে তামাকজাত দ্রব্যের উপর বাড়তি কর চাপানোর বিজ্ঞপ্তি জারি করল রাজ্যের অর্থ দফতর। কিন্তু বেসরকারি সংস্থার হাতে প্রতারিত মানুষকে ক্ষতিপূরণ দিতে এই ধরনের কর বসানো কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধীরা তো বটেই, মুখ্যমন্ত্রীর এই পদক্ষেপে আপত্তির কথা জানাচ্ছেন রাজ্য প্রশাসনের একাধিক শীর্ষ কর্তাও।
বুধবার বিশেষ তহবিল তৈরি করার কথা ঘোষণা করে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, মোট ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠিত হবে। এর মধ্যে ১৫০ কোটি টাকা আসবে তামাকজাত দ্রব্যের উপরে অতিরিক্ত কর বসিয়ে। সেই মতো এ দিন ১০ শতাংশ বাড়তি ভ্যাট চাপানোর বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে অর্থ দফতর। কিন্তু রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত এ দিনই আলিমুদ্দিনে সাংবাদিক বৈঠকে প্রশ্ন তোলেন, আর্থিক জালিয়াতির ক্ষতিপূরণে এ ভাবে সাধারণ মানুষের উপরে কর চাপানো নীতিগত ভাবে কতটা যুক্তিযুক্ত! একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, কর চাপিয়ে ১৫০ কোটি টাকা তোলার কথা বলা হলেও সেই টাকা তুলতে তো এক বছর লাগবে। তা হলে কি তত দিন পর্যন্ত আমানতকারীদের অপেক্ষা করতে হবে?
শুধু অসীমবাবু নন, তহবিল নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন রাজ্য প্রশাসনের একাংশও। তাঁদের বক্তব্য, টানাটানির সংসারে রাজস্ব বাড়াতে অতিরিক্ত ভ্যাট বসানো যেতেই পারে। কিন্তু ভুঁইফোড় আর্থিক সংস্থার হাতে প্রতারিতদের ক্ষতিপূরণ দিতে ওই কর আদায়টা আর্থিক বিধিনিয়ম সঙ্গত কিনা, তা নিয়ে সংশয়ী তাঁরা। ওই অফিসারদের বক্তব্য, এর আগে পরিকল্পনা বহির্ভূত খাত থেকে টাকা তুলে ঘুরপথে তা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করেছিল রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর। আমজনতার করের টাকায় দান-খয়রাতি করা যায় কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছিল তখনও।
তা ছাড়া, প্রতারিতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আর্থিক বোঝা সরকার নিজের কাঁধে নিলে ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থাগুলিই পরোক্ষে উৎসাহিত হবে বলে মনে করছেন মহাকরণের একাধিক অফিসার। তাঁদের প্রশ্ন, “যেখানে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলছেন, এই তছরূপের সঙ্গে সরকার জড়িত নয়, পুরোটাই বেসরকারি সংস্থায় ঘটেছে, সেখানে এই অর্থকষ্টের মধ্যে কেন অন্যের ‘বেআইনি’ কাজের দায় নেবে সরকার? এর পরে ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থাগুলি তো টাকা আত্মসাৎ করে আমানতকারীদের মহাকরণের দরজা দেখিয়ে দেবে! কোনও কোনও অফিসার এ-ও বলছেন যে, চোর-ডাকাত-প্রতারকদের পাল্লায় পড়ে সর্বস্ব খোয়ালে সরকারি ক্ষতিপূরণ দাবি করার পথ প্রশস্ত করছে রাজ্য।
সারদা-কাণ্ডের তহবিলের বাকি ৩৫০ কোটি টাকা কোথা থেকে আসবে, এ দিন সেই প্রশ্নও তুলেছেন অসীমবাবু। বুধবার তহবিল ঘোষণার সময় মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “১৫০ টাকা আমরা কর থেকে পেয়ে যাব। বাকি টাকা কোথা থেকে আসবে, তা এখনই বলছি না। তবে জনগণের উপরে যাতে চাপ না পড়ে, সেটা আমরা দেখব।” এই ৩৫০ কোটি টাকার উৎস কী, তা এ দিনও খোলসা করেনি মুখ্যমন্ত্রী।
সারদা-কাণ্ডের তদন্তে কমিশন গড়া নিয়েও আপত্তির কথা জানিয়েছেন অসীমবাবু। তাঁর মতে, এটা অযথা কালক্ষেপের নামান্তর। তিনি বলেন, সেবি কয়েক দিন আগেই নির্দেশ দিয়েছে, সারদা গোষ্ঠীকে তিন মাসের মধ্যে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে হবে। সাধারণ মানুষ যে টাকা বিনিয়োগ করেছেন, সেই টাকা উদ্ধার করাই এখন সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। অনুসন্ধান করে দেখা উচিত, এই টাকা কোনও রাজনৈতিক নেতাকে দেওয়া হয়েছে কি না, বা অন্য কোনও জায়গায় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না।
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী মতে, রাজ্য সরকারের উচিত সেবি, সিবিআই এবং কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুতর প্রতারণা অনুসন্ধান শাখার (এসএফআইও) সাহায্য নিয়ে সারদা গোষ্ঠীর নামী-বেনামী সম্পত্তি চিহ্নিত করা। কেউ অসৎ পথে সারদার টাকা পেয়ে থাকলে তাঁরও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা উচিত। তার পর দ্রুত আদালতে গিয়ে ওই সব সম্পত্তি নিলাম করে বিনিয়োগকারীদের ফিরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
অসীমবাবুর কথায়, “কমিশন অর্থ ফেরত দিতে পারবে না। তারা শুধু সুপারিশ করতে পারে। তাই কমিশনের সুপারিশ পাওয়ার পরে সরকারকে আদালতে গিয়েই এই কাজ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে রাজ্য নিজেই কেন সরাসরি আদালতে গিয়ে দ্রুত টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করছে না কেন?”
|