সারদা-কাণ্ডে প্রতারিতদের ক্ষতিপূরণের দায় কেন্দ্রের কাঁধেও চাপাতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার রাজ্যের তরফে ৫০০ কোটি টাকার তহবিল তৈরির কথা ঘোষণা করার পরে শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কেন্দ্র এ সবের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তাই কেন্দ্রও টাকা ফেরত দিক। আমি কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলব। টাকা ফেরত চাইব।” তাঁর যুক্তি, “যে হেতু সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া এবং রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানিজ এদের অনুমোদন দেয়, তাই এদেরই দেখার কথা। এরা দেখেনি কেন? তাই কেন্দ্র এ সবের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না।”
মমতা মূলত দু’টি কারণে সারদা-কাণ্ডের সঙ্গে কেন্দ্রকে যুক্ত করতে চাইছেন বলে মনে করছে প্রশাসনের একাংশ। প্রথমত, এই ঘটনায় যে ভাবে তৃণমূলের নাম জড়িয়ে গিয়েছে তা থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা। এবং দ্বিতীয়ত, ৫০০ কোটি টাকায় বিপুল সংখ্যক প্রতারিতের ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব নয় বুঝে আরও টাকা জোগাড় করার প্রয়াস।
শীর্ষ নেতারা জোর গলায় অস্বীকার করলেও সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে তৃণমূলের যোগাযোগের বিষয়টি যে জনমানসে ছাপ ফেলেছে, তা কবুল করছেন দলের নিচুস্তরের বহু নেতাই। পঞ্চায়েত ভোটের মুখে এই ঘটনায় গ্রামাঞ্চলের তৃণমূল নেতারা স্বাভাবিক ভাবেই উদ্বিগ্ন। এহেন পরিস্থিতিতে লক্ষ লক্ষ প্রতারিত আমানতকারী যখন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সুরাহা দাবি করছেন, তখন তাঁদের কার্যত হতাশ করে তিনি গোড়ায় বলেছিলেন, ‘যা গেছে তা গেছে’। এই মন্তব্য আরও বড় রাজনৈতিক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে বলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তৃণমূল নেতারা। পরিস্থিতি সামলাতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই অবস্থান পাল্টে তহবিল গড়ার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু সারদা-কাণ্ডের তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই উঠে আসছে তৃণমূল নেতাদের নাম। বৃহস্পতিবারই শাসক দলের এক সাংসদের নামে পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তৃণমূলের যোগাযোগ নিয়ে প্রচারও শুরু করে দিয়েছে বিরোধী সিপিএম এবং কংগ্রেস। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি এ দিন বলেছেন, “সারদা কেলেঙ্কারিতে চিট ফান্ড মালিকদের সঙ্গে তৃণমূলের নেতাদের যোগাযোগ প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে।” সে জন্য সিবিআই তদন্তের দাবিতেও সরব হয়েছে বাম-কংগ্রেস। |
মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের দাবি বিরোধীদের এই প্রচার ঠেকানোর একটা চেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে এ দিন লোকসভাতেও সরব হয়েছে তৃণমূল। আবার দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এবং রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর নেতৃত্বে কলেজ স্কোয়্যার থেকে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ পর্যন্ত মিছিলও করেছে তারা। কেন্দ্র এবং আগের বামফ্রন্ট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির রমরমা হয়েছে, এই অভিযোগ জানিয়ে আজ, শনিবার শিয়ালদহ থেকে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ পর্যন্ত মিছিল করবে তৃণমূল সেবা দল।
তবে শুধু রাজনৈতিক কারণেই নয়, আর্থিক কারণেও মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রকে এই কেলেঙ্কারিতে জড়াতে চেয়েছেন বলে প্রশাসনের একাংশের মত। কারণ, তহবিলের ৫০০ কোটি টাকা কোথা থেকে আসবে, তার হদিশ এখনও দিতে পারেননি মমতা। তহবিল ঘোষণার দিন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “১৫০ কোটি টাকা আমরা (সিগারেটের উপরে) কর থেকে পেয়ে যাব। বাকি টাকা কোথা থেকে আসবে, তা এখনই বলছি না।” সারদার সম্পত্তি বেচেও প্রয়োজনীয় টাকা উঠবে না বলেই প্রশাসনের আশঙ্কা। তা হলে সরকার কী করবে? এক কর্তার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বারবার বলছেন, সরকারের টাকা নেই। এই অবস্থায় বাড়তি ৩৫০ কোটি টাকা কোথা থেকে আসবে! সেই টাকা যাতে কেন্দ্রীয় সাহায্য থেকে জোগাড় করা যায়, সে জন্যই দিল্লির দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।”
তা ছাড়া, অন্য ভুঁইফোঁড় সংস্থায় টাকা রেখে প্রতারিতরাও এ বার ক্ষতিপূরণের দাবি তুলতে শুরু করবেন বলে ওই কর্তার আশঙ্কা। তাতে মুখ্যমন্ত্রীর উপরে চাপ আরও বাড়বে। বস্তুত সেই আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে ইতিমধ্যেই বীরভূম এবং বর্ধমানে অন্য সংস্থার এজেন্টরা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন। সিউড়িতে ‘সানমার্গ সুরাহা মাইক্রো ফিনান্স’ নামে একটি অর্থলগ্নি সংস্থার কয়েকশো এজেন্ট আর্থিক প্যাকেজের দাবিতে ঘণ্টাখানেক পথ অবরোধ করেন। বর্ধমানের কাটোয়ায় ‘অ্যানেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইন্ডিয়া লিমিটেড’ নামে একটি ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্টরাও একই দাবি জানিয়েছেন। এই বাড়তি চাপের মুখে টাকার জন্য কেন্দ্রের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর গত্যন্তর নেই বলেই প্রশাসনের বড় অংশের মত। |
সিবিআই তদন্ত: এই ঘটনা নিয়ে বেশ কয়েকটি তদন্ত চলছে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, যাঁরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন তাঁদের কিছু টাকা কি ফেরত দেওয়া যাবে?
৫০০ কোটির তহবিল: যথেষ্ট নয়। কিন্তু এটা একটা বড় প্রচেষ্টা।
এম কে নারায়ণন
রাজ্যপাল |
|
তবে মুখ্যমন্ত্রী দাবি জানালেও সারদা গোষ্ঠীর আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে আদৌ কোনও পদক্ষেপ করা যায় কি না, তা নিয়ে এখনও অথৈ জলে কেন্দ্র। এ নিয়ে দফায় দফায় অর্থ ও কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রকের বৈঠকের পরেও কোনও উপায় বের হয়নি। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের
বক্তব্য, আইন না মেনে যদি কোনও সংস্থা টাকা তোলে, তা হলে সেবি সেই সংস্থাকে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারে। গত মঙ্গলবারই সেবি সারদা রিয়েলটিকে তিন মাসের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
কিন্তু সারদা রিয়েলটি ছাড়াও সারদা গোষ্ঠীর আরও সংস্থা টাকা তুলেছে। তা ছাড়া, যে সংস্থার কর্ণধারই গ্রেফতার, সেই সংস্থা কী ভাবে টাকা ফেরত দেবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলেন, অনেক ক্ষেত্রে আদালতই ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির সম্পত্তি নিলাম করে বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে সেই টাকা আমানতকারীদের দেওয়ার নির্দেশ দেয়। সহারা-র ক্ষেত্রেও একই নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু সারদার ক্ষেত্রে এই দাওয়াই কতটা র্কাযকর হবে, তা নিয়ে সন্দিহান অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা। তাঁদের ধারণা, সারদা গোষ্ঠীর সম্পত্তি নিলাম করে বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে সব আমানতকারীর টাকা ফেরত দেওয়া যাবে না। এ বিষয়ে রাজ্য কী আইন আনছে, তা-ও দেখে নিতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার।
মুখ্যমন্ত্রীর দাবির বিরোধিতা করে অবশ্য এ দিনই সরব হয়েছে প্রদেশ কংগ্রেস। প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “এ রাজ্যে বাম আমল থেকেই একটা ধারা চলে আসছে। রাজ্য সরকার যখনই বিপদে পড়ে, অন্যায় করে, তখনই সেটা ঢাকার জন্য কেন্দ্রের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়।” সারদা-কাণ্ড নিয়ে কেন্দ্রের করণীয় খুবই কম, এই দাবি করে প্রদীপবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী কি জানেন না, ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরেই সেবি এ ধরনের বিভিন্ন সংস্থার সিইও-দের ডেকে তাদের সংশোধন করার পরামর্শ দিয়েছিল রাজ্য সরকারকে? কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক বার রাজ্যকে সতর্ক করা হয়েছে।”
সারদা-কাণ্ড নিয়ে তৃণমূলকে বিঁধলেও কেন্দ্রের দায়বদ্ধতার প্রশ্নে অবশ্য বামেরাও সরব। ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের দাবিতে তৃণমূলের সঙ্গে বামেরাও এ দিন বারবার লোকসভা অচল করে দেয়। যদিও কেন্দ্র কী ভাবে হস্তক্ষেপ করবে, সে ব্যাপারে দু’পক্ষের মতামত ভিন্ন।
|