গাড়ির দেরিতে মাসুল তুলছেন মাস্লম্যানেরা |
বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনালে অব্যবস্থার পিছনে কী? প্রশাসনিক অদক্ষতা, কর্মসংস্কৃতি,
যাত্রীদের মানসিকতা নাকি ইউনিয়নবাজির অঙ্ক? খুঁজে দেখল আনন্দবাজার। |
কলকাতা বিমানন্দরের নতুন টার্মিনালে আপনাকে ‘স্বাগত’ জানাতে তৈরি ৩০ জন মাস্লম্যান।
ওই টার্মিনালে ঢোকার মুখে রাস্তায় আটকানো হচ্ছে প্রতিটি গাড়ি। দ্বিতীয় হুগলি সেতু বা ডানকুনির মতো ‘টোল প্লাজা’ তৈরি হয়েছে সেখানে। সেই প্লাজার কাছে গাড়ি এসে দাঁড়ালেই চালকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে একটি চিরকুট। তাতে লেখা টার্মিনালে প্রবেশের সময়। প্লাজা পেরিয়ে গাড়ি থেকে যাত্রী নামানো অথবা যাত্রী তোলার জন্য বরাদ্দ ঠিক ১০ মিনিট। ফেরার পথে ওই চিরকুট পরীক্ষা করে সময় মিলিয়ে দেখা হবে। সময় অতিক্রম করলেই চালককে দিতে হবে ৬০ টাকা। সূত্রের খবর, এর পরে টার্মিনালের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে ক্রেন দিয়ে গাড়ি তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন ওই ৬০ টাকা ছাড়াও দিতে হবে ক্রেনের ভাড়া ও অতিরিক্ত জরিমানা।
সময় মেপে টাকা আদায় করার জন্য সুদূর হরিয়ানা থেকে আনা হয়েছে ৩০ জন মাস্লম্যানকে, যাঁরা সামান্য বেচাল দেখলেই বলছেন, ‘ওয়ে, পয়সা দেকে যাও।’ বিমানবন্দরের এক কর্তার কথায়, “বঙ্গবাসীকে শিক্ষা দিতেই এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।”
কীসের শিক্ষা?
ওই কর্তা জানান, বারংবার বলা সত্ত্বেও টার্মিনালের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখার অভ্যাস ছাড়েননি বঙ্গবাসী। তাই তাঁদের একটু ‘শিক্ষার’ প্রয়োজন আছে। সম্প্রতি এই ‘শিক্ষার’ খানিক নমুনা পেয়েছেন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক অরূপ সরকার। দিল্লি থেকে ফেরেন তিনি। আগেই জানতেন বলে সে দিন রীতিমতো হিসেব কষে চালককে টার্মিনালে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু নতুন টার্মিনালের ভিতরে অ্যারোব্রিজে আটকে পড়েন তিনি। চালক বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন। অরূপবাবুর কথায়, “আমরা অনেকে একসঙ্গে ছিলাম। সকলের গাড়িই বাইরে অপেক্ষা করছিল। বেরোনোর সময়ে টাকা নেওয়া শুরু হয়। কয়েক জন দিয়েও দেন। তার পরে শুরু হয় গণ্ডগোল। অনেকে গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার শুরু করেন। বেগতিক দেখে পরের দিকের গাড়িগুলিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।” শুধু অরূপবাবু নন, কলকাতায় এলে এই সমস্যায় পড়ছেন অন্যেরাও। এক জাঠ গাড়িচালকের কলার চেপে ধরে টাকা আদায় করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এক যাত্রী বলেন, “ওই মাস্লম্যানরা বাংলা বোঝেন না। তাঁরা বয়স্ক ও যুবকদের মধ্যে ফারাক করছেন না।”
বিমানবন্দর-কর্তৃপক্ষ যথারীতি নিজেদের মতো যুক্তি সাজিয়েছেন। সংস্থার অধিকর্তা বি পি শর্মা বলেন, “আমরা হিসেব করে দেখেছি, একটি গাড়ির টার্মিনালে ঢুকে যাত্রী নামিয়ে চলে যেতে সময় লাগে বড় জোর তিন মিনিট। তার উপরে আরও সাত মিনিট ছাড় দেওয়া হচ্ছে।” পার্কিংয়ের দায়িত্ব পাওয়া মহেশ সানি-র স্থানীয় ম্যানেজার বাবুলাল যাদবের কথায়, “আমদাবাদে এই নিয়ম পাঁচ মিনিটের জন্য রয়েছে। তবে বয়স্ক, অসুস্থ ব্যক্তি হলে আমরা ওই টাকা নিই না।”
যাত্রীরা অবশ্য দেরির জন্য ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা, কোনও যাত্রীকে বিমানবন্দর থেকে নিতেই সময় বেশি লাগছে। অনেক সময়ে কনভেয়ার বেল্ট থেকে স্যুটকেস পেতে দেরি হচ্ছে। আবার, ফেরার পথে কাগজ পরীক্ষার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে কেটে যাচ্ছে কয়েক মিনিট। বি পি শর্মা অবশ্য এ সব মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, “এখানকার গাড়িগুলির প্রবণতাই হচ্ছে টার্মিনালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা। ‘ফাইন’ আদায় না করলে বহু গাড়ি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে।”
কিন্তু টাকা আদায় করতে স্থানীয় যুবকদের নেওয়া হল না কেন? বিমানবন্দর সূত্রের খবর, বরাত পাওয়া সংস্থাটি ৩৮ জন স্থানীয় যুবককে নিয়োগ করেছে। কিন্তু তাঁদের কাজ শুধু গাড়ি ঢোকার সময়ে চিরকুট দেওয়া। গাড়ি বেরোনোর সময়ে চিরকুট পরীক্ষা করে টাকা তোলার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন হরিয়ানার ওই মাস্লম্যানরা।
অভিযোগ উঠেছে, যে রাস্তায় গাড়ি আটকে টাকা নেওয়া হচ্ছে, সেটি বিমানবন্দরের জমি। রাস্তা ব্যবহারের জন্যই টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। যদিও রাজ্য সরকারের পদস্থ এক কর্তা বলেন, “রাজ্যের পুর-আইন অনুযায়ী গাড়ি পার্কিং-এ রাখলে টাকা নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু রাস্তা ব্যবহারের জন্য টাকা নেওয়ার কোনও নিয়ম নেই। কারণ, সেটা পরিষেবা দেওয়ার মধ্যে পড়ে না।”
|