বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনালে অব্যবস্থার পিছনে কী? প্রশাসনিক অদক্ষতা, কর্মসংস্কৃতি, যাত্রীদের
মানসিকতা নাকি ইউনিয়নবাজির অঙ্ক? খুঁজে দেখল আনন্দবাজার। আজ প্রথম কিস্তি। |
চেহারাটাই ঝাঁ-চকচকে হয়েছে। চরিত্র বদলায়নি!
কলকাতা বিমানবন্দরে নতুন টার্মিনালের শৌচালয়ে ঢুকে এক মহিলা যাত্রী দেখেন, কল থেকে জল পড়ছে না! সেখানেই দাঁড়িয়ে শৌচালয়ের দায়িত্বে থাকা বেসরকারি পেশাদার সংস্থার মহিলা কর্মী। কানে হেড ফোন। ভ্রূক্ষেপ নেই তাঁর!
এক পুরুষ যাত্রী শৌচালয়ে ঢুকে দেখতে পান, হাত মোছার কোনও কাগজ নেই! অনেক খোঁজাখুঁজির পরে তিনি দেখেন, তিন-চার জন সাফাইকর্মী দূরে দাঁড়িয়ে গল্পে মশগুল। কাগজ যে নেই, তা তাঁরা জানেনই না। বলার পরে শুরু হয় তৎপরতা।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেজে উঠেছে কলকাতা বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল। নিয়মিত যাঁরা টার্মিনাল দিয়ে যাতায়াত করছেন, তাঁদের অভিযোগ, শৌচালয়ের মতো কিছু পরিষেবায় সেই পুরনো চেহারা। নতুন টার্মিনালে বেশির ভাগ পরিষেবার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি পেশাদার সংস্থার হাতে। কিন্ত হাল ফেরেনি।
কেন? অভিযোগ উঠছে রাজনৈতিক ‘দাদাগিরি’র। কর্তৃপক্ষ মুখে না বললেও মেনে নিচ্ছেন সেই অভিযোগ। পুরনো টার্মিনালেশৌচালয় পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব ছিল স্থায়ী কর্মীদের উপরে। অভিযোগ, তাঁদের মাথার উপরে যেমন রাজনীতির ছাতা ছিল, নতুন টার্মিনালে পেশাদার সংস্থার হয়ে কাজ করতে আসা বহু কর্মীর মাথাতেও রয়েছে সেই ‘দাদাদের’ ছাতা। শুধু বদলে গিয়েছে ছাতার রং। তাই যতই ‘পেশাদারিত্ব’ দেখানোর কথা বলুন কর্তৃপক্ষ, বদলায়নি কর্মীদের মানসিকতা। ঠিক আগের মতোই, মাথার উপরে দাদাদের স্নেহের হাত থাকায় নতুন টার্মিনালেও কাজে গাফিলতিতে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। |
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, পুরনো টার্মিনালের শৌচালয় নোংরা থাকার অভিযোগ আসত প্রতিদিন। বেশির ভাগ স্থায়ী কর্মী নিয়মিত কাজ করছিলেন না বলে অভিযোগ আসত। এই প্রেক্ষিতেই পেশাদার সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিমানবন্দরের ওই কর্তার আক্ষেপ, “পরিবর্তন করেও ফল হল সেই একই। যাঁরা কাজ করেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর সাহস নেই কারও। ফোন চলে যাবে কোনও এক ‘দাদা’র কাছে। উল্টে ধমক খেতে হতে পারে।”
বিমানবন্দরের এক কর্তার কথায়, “এটাই এই রাজ্যের দস্তুর। গুণমান বজায় রেখে কাজ করতে চাইলেও আপনি পারবেন না। কারণ, কাজ করতে গেলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে যাঁদের চাকরি দিতে হবে, তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। তাই গুণমানের সঙ্গে আপস করে চলতে হয়। সেখানে কঠোর হলে কাজ করাই দায় হয়ে দাঁড়াবে।” ওই কর্তার অভিযোগ, “এ রাজ্যে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে নিচু মানের মাল কিনে যেমন বাড়ি বানাতে বাধ্য হন মানুষ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে যেমন হলদিয়া বন্দর থেকে এবিজি-কে চলে যেতে হয়, তেমনই কোনও পেশাদার সংস্থা না চাইলেও বিমানবন্দরের কাজে নেতাদের কথায় লোক নিয়োগ করতে হয়।”
বিমানবন্দর সূত্রের খবর, দিল্লির যে সংস্থাকে নতুন টার্মিনাল পরিচ্ছন্ন রাখার বরাত দেওয়া হয়েছে, তার অধীনে এখন প্রায় ১৮০ জন কর্মী কাজ করছেন। সংখ্যাটা প্রয়োজনের তুলনায় কম বলে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু ওই ১৮০ জনের মধ্যে প্রায় ৪০% কর্মী নিয়োগ করতে হয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সংস্থার এক কর্তার কথায়, “এখানে কাজের বরাত পাওয়ার পরে বিমানবন্দরের তিনটি ইউনিয়নের তিন জন নেতা আমাকে লোক নেওয়ার অনুরোধ করে ফোন করেন। যা প্রকারান্তরে নির্দেশ।” |
কলকাতা বিমানবন্দরে তৃণমূলের ইউনিয়ন দেখভালের দায়িত্ব রয়েছে দমদমের স্থানীয় নেতা বরুণ নট্ট-র উপরে। লোক নিয়োগের সুপারিশ করার কথা স্বীকার করে নিয়ে তাঁর বক্তব্য, “শুধু আমরা কেন? কংগ্রেস, সিপিএম-ও তো লোক ঢুকিয়েছে। আমাদের সুপারিশে যাঁরা ঢুকেছেন, তাঁরা কাজ না করলে বার করে দিক।” বিমানবন্দরে সাফাইয়ের কাজে নিযুক্ত বেশ কয়েক জন যুবক-যুবতীর অভিযোগ, “আমাদের এক-এক জনের উপরে চারটি করে শৌচালয় পরিষ্কারের দায়িত্ব। অথচ আমাদের মধ্যেই এমন কয়েক জন রয়েছেন, যাঁরা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।”
তবে যাত্রীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে কর্মীদের। যেমন, গুটখা ফেলে বেসিন লাল করে দেওয়া হচ্ছে। সেটা পরিষ্কার করার আগেই কোনও যাত্রী চলে এলে তিনি ছিটকে সরে যাচ্ছেন। টার্মিনালের ৬৩টি শৌচালয়ের সব ক’টিতেই কমোড বসানো। অনেকেই নাকি জুতো পরে কমোডের উপরে উঠে বসছেন। কমোড ব্যবহার করতে না পারায় অনেক মহিলা মেঝেতেই প্রাকৃতিক কাজ সারছেন। এক কর্মীর কথায়, “এক দিন দেখি শৌচালয়ের দরজা বন্ধ। ভিতর থেকে হুড়হুড় করে জল বেরিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পরে এক যাত্রী বেরিয়ে জানান, কমোডের পাশে রাখা ‘হ্যান্ড-শাওয়ার’ দিয়েই তিনি স্নান সারলেন।”
|