কলকাতা হাইকোর্ট বেআইনি ঘোষণা করেছিল আগেই। তবু প্রশাসনের নাকের ডগাতেই হাওড়ার পোদরা ঘাট থেকে গার্ডেনরিচের রাজাবাগান ঘাট পর্যন্ত বছরের পর বছর ধরে চলছিল অবৈধ নৌকা চলাচল। বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ তেমনই একটি নৌকা যাত্রী পারাপার করার সময়ে রাজাবাগান ঘাটের কাছে উপকূলরক্ষী বাহিনীর একটি জাহাজের নোঙর করার দড়িতে জড়িয়ে গিয়ে উল্টে যায় মাঝ গঙ্গায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ওই ঘটনার সময়ে গঙ্গায় জোয়ার এসেছিল। উল্টে যাওয়ার পরেই নৌকাটি জোয়ারের তীব্র স্রোতে দু’টুকরো হয়ে জলে তলিয়ে যায়। ভেসে যান অন্তত ৩২ জন যাত্রী। তাঁদের মধ্যে ২৯ জনকে গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্সের কর্মী ও উপকূলরক্ষী বাহিনীর জওয়ানেরাই উদ্ধার করেন। বুধবার বিকেল পর্যন্ত নিখোঁজদের উদ্ধারের জন্য তল্লাশি চললেও আর কাউকে উদ্ধার করা যায়নি। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানিয়েছে, নিখোঁজদের মধ্যে রয়েছেন নৌকার এক মাঝি, পিঙ্কি নামে বছর তিরিশের এক মহিলা ও তাঁর তিন বছরের মেয়ে ফারহিন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, এ দিন সকাল ১০টা নাগাদ হাওড়ার পোদরা ঘাট থেকে যাত্রীদের নিয়ে নৌকাটি রাজাবাগান ঘাটের উদ্দেশে যাত্রা করে। নৌকায় যাত্রী ছাড়াও তোলা হয়েছিল চার বস্তা চাল, দু’টি মোটরবাইক ও আটটি সাইকেল। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নদীতে তখন সবে জোয়ার এসেছিল। নৌকার মাঝিরা ওপারে গিয়ে নদীর কিছুটা পাড় ঘেঁষে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ওপারে তখন গার্ডেনরিচের একটি জেটিতে নোঙর করা ছিল ‘রাজদূত’ নামে উপকূলরক্ষী বাহিনীর একটি জাহাজ। জাহাজটি পাড়ের সঙ্গে মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। দড়িগুলো পড়েছিল নদীর উপরে। |
উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের মধ্যে জয়মঙ্গল দাস ও তারক প্রধান নামে রাজাবাগানের দুই বাসিন্দা জানান, জোয়ারের প্রবল টান থাকায় নৌকাটি ঘাটের দিকে না গিয়ে জাহাজের দিকে চলে আসে। নৌকায় থাকা মোটরবাইকের হ্যান্ডেলে জাহাজের নোঙর করার দড়ি জড়িয়ে যায়। যাত্রীরা তা দেখে ভয় পেয়ে নৌকার এক দিকে চলে আসেন। তাতেই নৌকাটি উল্টে যায়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, উপকূলরক্ষী জাহাজের ক্যাপ্টেন কম্যান্ডার অনুপম রাই বলেন, “ওই সময়ে নদীতে প্রচণ্ড স্রোত ছিল। দেখি, নৌকাটা উল্টে যাওয়ার পরেই দু’টুকরো হয়ে ভেঙে গেল। ভেসে গেলেন সবাই। স্রোতের টানে যে সব যাত্রী আমাদের জেটির দিকে ভেসে এসেছিলেন, আমাদের জওয়ানেরা লাইফ গার্ড ও দড়ি ফেলে তাঁদের অনেককে উদ্ধার করে।”
নদীতে ভেসে যাওয়ার সময়ে সুজিত অধিকারী নামে এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করেন উপকূলরক্ষী বাহিনীর জওয়ানেরা। ঘটনার পরে রাজাবাগান ঘাটে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “স্রোতের টানে আমি জেটির নীচে ঢুকে যাচ্ছিলাম। ভাসতে ভাসতে মাথার উপরে একটা দড়ি দেখতে পেয়ে আঁকড়ে ধরি।”
এ দিকে, ঘটনার খবর পেয়ে রাজাবাগানের গঙ্গার ঘাটে এসে জড়ো হন ডুবে যাওয়া নৌকার যাত্রীদের আত্মীয়েরা। মহম্মদ জিয়াউদ্দিন নামে পোদরার এক বাসিন্দা জানান, তাঁর দাদা-বৌদি দুই মেয়েকে নিয়ে এপারে আসছিলেন। দাদা ও এক মেয়েকে পাওয়া গেলেও বৌদি পিঙ্কি ও তাঁর মেয়ে ফারহিনকে পাওয়া যাচ্ছে না।
ঘটনার খবর পেয়ে হাওড়ার পোদরা ঘাটেও বহু মানুষ জড়ো হন। স্থানীয় বাসিন্দা পার্থসারথি মণ্ডল বলেন, “অবৈধ ভুটভুটি ও নৌকা বন্ধ করার জন্য আমরা আদালতে মামলা করেছিলাম। কলকাতা হাইকোর্ট ২০০৭ সালে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছিল। কিন্তু কিছু দিন বন্ধ থাকার পরে ফের নৌকা চলাচল শুরু হয়।”
ঘটনার পরে বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন কলকাতা পুলিশের ডিসি (বন্দর) ভি সলোমন-সহ পদস্থ পুলিশকর্তারা। হাওড়ার দিক থেকেও আসেন হাওড়া জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা-সহ অন্য পুলিশকর্তারা। দুপুর ১২টা নাগাদ উদ্ধারকাজে নামেন বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর ডুবুরিরা।
দুপুর দেড়টা নাগাদ উদ্ধারকাজ তদারকি করতে রাজাবাগানে গঙ্গার ঘাটে আসেন এলাকার বিধায়ক এবং পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং দমকল ও বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের মন্ত্রী জাভেদ খান। পুরমন্ত্রী বলেন, “ওই ঘাট দু’টিতে অবৈধ নৌকা বাম আমল থেকেই চলছে। তৃণমূল মাত্র দেড় বছর সরকারে এসেছে। এর মধ্যে সব কিছু পাল্টে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে খবর পেলেই এ ধরনের বেআইনি নৌকা বন্ধ করে দেওয়া হয়।” ডিসি (বন্দর) বলেন, “ঘটনার পরেই মোট ২৯ জন যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এক মাঝি-সহ বাকি ৩ জনের খোঁজে তল্লাশি চলছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁদের সন্ধান মেলেনি।” |