বছর ছ’য়েক আগেও মায়ের সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় আচার বিক্রি করে সংসার চালাতেন যে যুবতী আজকাল তাঁরই পরনে থাকত মহার্ঘ শাড়ি!
ইচ্ছা হলেই ‘ম্যাজিসিয়ানের’ মতো হাজার-হাজার টাকা মুহূর্তে কাউকে দিতে পারতেন তিনি।
তিনি দেবযানী মুখোপাধ্যায়। সারদা গোষ্ঠীর অন্যতম কর্ত্রী। ঢাকুরিয়া স্টেশন রোডে দেবযানীর আবাসনের এক বাসিন্দা বলছিলেন, “মাঝেমধ্যেই গভীর রাতে ওই ফ্ল্যাটে বিরাট বিরাট বস্তা আসত। সকালে আনা হত লোহার বড় ট্র্যাঙ্ক। ওঁকে জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, বিষ্ণুপুরের ভাসায় ওঁদের অফিসের জমিতে চাষ হয়। সেখান থেকে ধান আসে।”
দু’হাতে দেদার টাকা খরচের সেই ম্যাজিক যে ওই বস্তাতেই লুকিয়ে ছিল এখন বুঝতে পারছেন এলাকার মানুষ। মুখোপাধ্যায় পরিবারের বড় মেয়ের ঐশ্বর্য্যের গল্প ঘুরছে তাঁদের মুখে-মুখে।
এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এক কালে মুখোপাধ্যায় পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল। তাঁদের পারিবারিক দোতলা বাড়িতে এক সময়ে হরিণ পোষা হত। তাই লোকমুখে ওই বাড়ির নাম হয়ে যায় ‘হরিণবাড়ি’। এই পরিবারের নামেই এলাকাটি মুখার্জীপাড়া নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু পরে অবস্থা পড়তে থাকে। লোকসানের জেরে পারিবারিক তেল কলের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। তখন ঢাকুরিয়ায় একটি রেশন দোকানে স্বল্প বেতনের চাকরি করতেন দেবযানীর বাবা তিমির মুখোপাধ্যায়। পাড়ায় তাঁর ডাকনাম ছিল মোহনবাবু। সংসারের খরচ টানতে রাস্তায়-রাস্তায় মা শর্বরীদেবীকে নিয়ে আচার ফেরি করতে হত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পড়ুয়া দেবযানীকে।
বছর পাঁচ-ছয় আগে থেকে ছবিটা আবার হঠাৎই পাল্টে যায়। কী রকম? স্থানীয় এক শাড়ি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বছর তিনেক ধরে প্রতি মাসে ৩-৪টি করে শাড়ি কিনতেন সারদা গোষ্ঠীর দোর্দণ্ডপ্রতাপ ‘ম্যাডাম’। বাবুবাগানের ওই শাড়ি ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, লাখ টাকার কমে ‘বিল’ হত না। তাঁর কথায়, “উনি এক বারই আমার দোকানে এসেছিলেন। তার পর থেকে ড্রাইভারকে পাঠাতেন। নগদ টাকা পাঠিয়ে দিতেন তাঁর হাতেই।” |
দু’হাতে টাকা খরচের আরও উদাহরণ পেয়েছেন এলাকার মানুষ। দুর্গাপুজো হোক বা পাড়ার কোনও অনুষ্ঠান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন দেবযানী। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ঢাকুরিয়া পোস্ট অফিসের কাছে অল্প বাজেটের সর্বজনীন পুজোর বাজেটও তাই পৌঁছে গিয়েছিল ৫ লক্ষের উপরে। তাঁর দানধ্যানের সুফল ভোগ করেছেন অনেকেই। ঢাকুরিয়া স্টেশনের সামনের বাজারের এক মাছ-বিক্রেতা জানান, “ব্যবসায় খুব লোকসান হয়েছিল কয়েক দিন আগে। দিদিকে (দেবযানী) সব কথা বলতেই নগদ ৭০ হাজার টাকা হাতে গুঁজে দিয়েছিলেন।” আপদে-বিপদে এ রকম অর্থসাহায্য পেয়েছেন এলাকার অনেকেই।
প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, পালাবদলের শুরু ২০০৭ সালে। ওই সময়ই সারদা গোষ্ঠীতে চাকরি পান দেবযানী। তাঁর খুড়তুতো বোন অর্পিতা দাবি করেছেন, তাঁর দিদি সারদা-র সাধারণ কর্মী হিসেবেই শুরু করেছিলেন। “আমার দিদি সংস্থার শেক্সপিয়র সরণির একটি শাখায় রিসেপশনিস্ট পদে যোগ দেন। পরে সুদীপ্তবাবু দিদিকে সংস্থার এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর পদে বসান।” চাকরি পাওয়ার পরের বছরই ঢাকুরিয়ায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন দেবযানী। কিছু দিন পর স্থানীয় একটি আবাসনে বড় মাপের একটি ফ্ল্যাট কেনেন। যদিও অর্পিতার দাবি, ঢাকুরিয়া স্টেশন রোডের চার তলার ওই ফ্ল্যাট সুদীপ্তবাবুই তাঁর দিদিকে উপহার দেন। তবে এলাকার প্রোমোটাররা বলছেন, ফ্ল্যাট-বাড়ি কেনাবেচার ব্যবসাতেও ভাল মতোই জড়িয়ে পড়েছিলেন দেবযানী। এক প্রোমোটার দাবি করলেন, “পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন আবাসন গড়ার বেশ কিছু প্রকল্পে দিদি কোটি কোটি টাকা ঢেলেছিলেন। আশপাশের কয়েকটি পুরনো বাড়িও কিনেছিলেন।”
এত দ্রুত অবস্থা বদল দেখে কারও কোনও সন্দেহ হয়নি কখনও? দেবযানীর খুড়তুতো এক বৌদি বলেন, “কী করে এতটা স্বচ্ছলতা এল, দেবযানীকে জিজ্ঞাসা করতাম। বলেছিল, ‘মোটা মাইনের কাজ করি তাই’। আমার কিন্তু ঠিক বিশ্বাস হয়নি।”
আত্মীয়দের মতো এলাকার মানুষও এখন বুঝতে পারছেন, কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় পাল্টে গিয়েছিল একটি সাধারণ মেয়ের জীবন।
|