এ যেন চোরের ঘরে বাটপাড়ির গল্প। যে সুদীপ্ত সেন লক্ষ লক্ষ আমানতকারীকে প্রতারণার দায়ে এখন পুলিশ হেফাজতে, তাঁর ঘরেই দীর্ঘদিন ধরে সিঁধ কেটেছেন তাঁরই ঘনিষ্ঠরা। তদন্তে নেমে তা জানতে পারে পুলিশ। পুলিশের একটি সূত্রের বক্তব্য, যে প্রতারণা ব্যবসা খুলে বসেছিলেন সুদীপ্ত, তাতে তাঁর সাম্রাজ্য এক দিন ভেঙে পড়তই। তবে অন্য কারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠদের পাল্টা প্রতারণাও সেই ভাঙনকে ত্বরান্বিত করেছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, সারদার পন্জি স্কিম ভেঙে পড়বে ধরে নিয়ে বছর দুয়েক আগে থেকেই আমানতকারীদের টাকা সরিয়ে বেনামে সম্পত্তি কেনার কাজ শুরু করেছিলেন সুদীপ্ত সেন। তত দিনে কিন্তু তাঁর ঘরে সিঁধ কাটার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। তদন্তে পুলিশ জেনেছে, সুদীপ্তর কিছু বিশ্বস্ত কর্মী এবং এজেন্টই ছিলেন বিভীষণ। তাঁরাই আমানতকারীদের টাকা মাঝপথে উধাও করে দিচ্ছিলেন। ফলে সুদীপ্তবাবুর কোষাগারে টাকা জমা পড়ার বদলে উল্টে মোটা টাকা বেরিয়ে যাচ্ছিল।
তাঁর ঘরেই যে চুরি চলছে, সেটা সারদার মালিক প্রথম বুঝতে পারেন গত বছর নভেম্বরে। সূত্রের খবর, তত দিনে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, দিনের খরচও উঠছে না। সারদার সব ক’টি সংস্থা চালাতে প্রতিদিন খরচ হতো গড়ে ৮০ লক্ষ টাকা। দেখা যাচ্ছিল, সেই টাকাও জোগাড় হচ্ছে না। তদন্ত সূত্রে খবর, সেই সময় ঘনিষ্ঠদের কাছে সুদীপ্তবাবু এমনও বলেছিলেন যে, তিনি আত্মহত্যা করবেন। যদিও তত দিনে সারদায় আমানতকারীদের মোটা টাকা তিনি পুরোদমে অন্যত্র সরাতে শুরু করে দিয়েছেন বলেই জানা গিয়েছে।
তদন্তকারী অফিসারেরা জানিয়েছেন, শুধু এই বিভীষণেরাই নন, সাফারি নামে একটি সফ্টওয়্যার ব্যবহার করেও ডুবেছে সারদা। বস্তুত, বিভীষণেরা ওই সফ্টওয়্যারটিকে কাজে লাগিয়েই বাটপাড়ি করেছেন বলে তদন্তকারীদের একটি অংশের ধারণা। পুলিশের এক কর্তা বলেন, “হিসেবের খাতায় জমা-খরচে কোনও গরমিল নেই। অথচ সারদার ভাঁড়ারে আমানতকারীদের টাকা জমা পড়ত না শেষের দিকে।” তাঁর মন্তব্য, “উৎপাতের ধন চিৎপাতে গিয়েছে।”
ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের একটি অংশ কী ভাবে ঠকিয়েছেন সুদীপ্ত সেনকে?
তদন্তকারী অফিসারেরা জানাচ্ছেন, সাফারি নামে সফ্টওয়্যারটির সাহায্যে টাকা তোলার কারবারের হিসেব রাখা যায়। এক জন আমানতকারী কোনও একটি ‘স্কিমে’ টাকা রাখলে সফ্টওয়্যার থেকে একটি পলিসি সার্টিফিকেট বের করে তাঁকে দেওয়া হতো। ঠিক যেমন জীবন বিমা পলিসি কেনার সময় দেওয়া হয়। এতে প্রিমিয়াম জমা করার তারিখ, পরিমাণ, স্কিমের মেয়াদ শেষের তারিখ এবং কত টাকা ফেরত পাওয়া যাবে, তা লেখা থাকত।
কিন্তু গোলমালটা ছিল অন্য জায়গায়। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, আসলে সারদার টাকা জমা নেওয়ার সফ্টওয়্যারটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ফলে সফ্টওয়্যারে দেখানো জমা টাকা ব্যাঙ্কেও জমা পড়ছে কি না, তা জানার অবকাশ ছিল না। সুদীপ্তবাবু হাতে পেতেন রোজকার হিসেবের একটি প্রিন্ট আউট। সেখানে আমানতকারীদের নাম ধরে ধরে এন্ট্রি থাকত। সুদীপ্তবাবু কম্পিউটারে খুব সরগড় ছিলেন না বলেই পুলিশ প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছে।
এই পরিস্থিতির ফায়দা তুলেই বিভীষণেরা টাকা সরিয়ে ছিলেন বলে পুলিশের প্রাথমিক অনুমান। তদন্তকারীদের বক্তব্য, সারদার সবচেয়ে জনপ্রিয় স্কিমগুলি ৬ মাস বা ১ বছর মেয়াদি। কম সময়ে বেশি টাকা ফেরতের লোভে বহু মানুষ এই দু’টি স্কিমে টাকা রাখতেন। টাকা জমা নেওয়া হতো সারদার শাখা অফিসগুলিতে। শাখা-প্রধানদের কাছে থাকত সফটওয়্যার চালানোর পাসওয়ার্ড। টাকা জমা পড়লে তা সংশ্লিষ্ট আমানতকারীর নামে এন্ট্রি করা হত। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, সফ্টওয়্যারে টাকা জমার ঘরে এন্ট্রি করা হলেও বাস্তবে তা সারদার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়েনি। পুলিশের খবর, অনেক সময় আমানতকারীরা দু-তিনটি কিস্তি দিয়ে হয়তো আর স্কিমটি চালাতে পারতেন না। নিয়ম অনুযায়ী, তখন ওই আমানতকারীর স্কিমটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সফ্টওয়্যারে তা ‘চালু’ দেখানো হতো। স্কিমের মেয়াদ শেষে ‘ম্যাচিওরিটি’র পুরো টাকাই তুলে নিতেন সংশ্লিষ্ট কর্তা অথবা এজেন্ট। সে জন্য সিস্টেমে নামও বদলে ফেলা হতো।
স্বল্পমেয়াদি স্কিমগুলির ক্ষেত্রে এই প্রতারণা ধরতে পারেননি সুদীপ্তবাবু। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি স্কিমগুলির টাকা ফেরতের সময় যত এগিয়ে আসে, তত তিনি বুঝতে পারেন, আমদানির চেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ঢের বেশি টাকা। তখন তাঁর সন্দেহ হয়। সল্টলেকের ডিএন-২৯ অফিসের কয়েক জন কর্তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেন। সংস্থার যাবতীয় হিসেব দেখার জন্য কাঁকুড়গাছির বাসিন্দা সুদীপ ঘোষদস্তিদার বলে এক ব্যক্তির উপর নির্ভর করতেন তিনি। সাফারি-র মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁরই হাতে। সুদীপ্তবাবু সন্দেহ করতে শুরু করেন, সুদীপই মাঝপথে টাকা সরাচ্ছেন। নভেম্বর মাসে এই ঘটনা ধরা পড়ার কিছু দিনের মধ্যেই সারদা ছেড়ে উধাও হন সুদীপবাবু। পুলিশ তাঁরও খোঁজ করছে।
তদন্তকারীরা অবশ্য বলছেন, ঘনিষ্ঠদের প্রতারণাই সারদার সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার একমাত্র কারণ নয়। তাঁদের বক্তব্য, নতুন টাকার অভাব হলেই পন্জি স্কিমের ভেঙে পড়ার কথা। এবং সেই সময়ে সংস্থা মালিকদের উধাও হয়ে যাওয়াটাই দস্তুর। সারদার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নভেম্বরে যে সংস্থায় বিপদের আঁচ পাওয়া গিয়েছিল, সেই সংস্থা জানুয়ারি থেকে আর কর্মীদের বেতন দিতে পারেনি। কোনও ভেন্ডরকেও টাকা দিতে পারেনি। সারদা বন্ধ হয়ে যাওয়া তখন সময়ের অপেক্ষা। আর আমানতকারীদের সর্বনাশেরও।
|