কর্মী থেকে কর্ণধার, সুদীপ্তর উত্থান যেন সিনেমা
য়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে মালিকের মাথায় গুলি। একদা হুকুমবর্দার হয়ে উঠলেন সর্বময় কর্তা। শঠতা-ক্রুরতায় জুড়ি মেলা ভার, দাপটে সকলে থরহরি কম্পমান। সত্তর-আশির দশকের আদর্শ বলিউডি চিত্রনাট্য!
সারদা-সাম্রাজ্য বিস্তারের নেপথ্যে এমন ফিল্মি ছায়াই দেখছেন অনেকে। চোদ্দো বছর আগে দিনে-দুপুরে মাথায় গুলি খেয়ে খুন হয়েছিলেন সারদা গার্ডেন সংস্থার মালিক বিশ্বনাথ অধিকারী। তাঁর জমি-বাড়ি-কারবার হাতের মুঠোয় নিয়ে নেন সংস্থার অফিস ম্যানেজার সুদীপ্ত সেন। সেটাই ফুলে-ফেঁপে হয়ে উঠেছে আজকের সারদা গোষ্ঠী। রুপোলি পর্দায় যে ভাবে দিনের পর দিন সাঙ্গোপাঙ্গদের পাশে নিয়ে প্রতিপত্তি বিস্তার করে গিয়েছেন অমরীশ পুরি-প্রেম চোপড়া-শক্তি কপূরেরা, প্রায় একই কায়দায় সুদীপ্ত সেনও তাঁর ব্যবসার পরিধি ও বহর বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
কীসের ভিত্তিতে?
ওই সময়ে যাঁরা সুদীপ্তকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁদের অনেকের বক্তব্য: দক্ষিণ শহরতলির ডায়মন্ড হারবার রোড লাগোয়া পূর্ব-বিষ্ণুপুর পঞ্চায়েত-এলাকার তিনটি মৌজার প্রায় হাজার বিঘে জমি কার্যত জবরদস্তি গরিব চাষিদের কাছ থেকে জলের দরে কিনে নিয়েছিল সারদা গোষ্ঠী। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ: এ জন্য সুদীপ্ত গড়েছিলেন একটি পুরোদস্তুর গুন্ডাবাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিল পীযূষ নস্কর ও প্রশান্ত নস্কর একদা বিষ্ণুপুর-ধর্মতলা রুটের বেসরকারি বাসের দুই খালাসি। ‘সেন সাহেবের’ দলে ভিড়ে তারাই হয়ে ওঠে জমি দখলের পাণ্ডা। অভিযোগ, সুদীপ্তের কাজ হাসিল করতে লোকজন জুটিয়ে নেমে পড়ে দুই নস্কর। বাগি, উত্তর গৌরীপুর ও ভাসা মৌজায় প্রায় হাজার বিঘে সারদার কব্জায় আসে।
বিষ্ণুপুরের জমিতে গজিয়ে ওঠা সারদার আবাসন প্রকল্প। —নিজস্ব চিত্র
এবং ধামাচাপা পড়ে যায় বিশ্বনাথ অধিকারী খুনের মামলা।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর: ১৯৯৯-এর ২৯ জানুয়ারির সেই সকালে সারদা গার্ডেনের পাশে অন্য একটি জমি দেখতে গিয়েছিলেন বিশ্বনাথবাবু। সাড়ে এগারোটা নাগাদ সেখানেই তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়। জমি দেখানোর ‘টোপ’ দিয়েই তাঁকে ফাঁদে ফেলা হয়েছিল বলে স্থানীয় সূত্রের ইঙ্গিত। পুলিশ ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ আততায়ীদের নামে মামলা রুজু করে। প্রথমে কেউ গ্রেফতার হয়নি। শেষমেশ হাইকোর্টের নির্দেশে সিআইডি তদন্তে নেমে তিন জনকে ধরে। ২০০৭ পর্যন্ত জেল খেটে তারা জামিনে খালাস হয়ে যায়। মামলা কার্যত চলে যায় ঠান্ডা ঘরে।
তবে সারদা-কাণ্ডের পরে উদ্ভুত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সেটিকে জিইয়ে তোলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর-সূত্রের ইঙ্গিত, বিশ্বনাথ-হত্যায় এ বার সুদীপ্তবাবুকে অভিযুক্ত করে মামলাটি ফের কোর্টে তোলা যায় কিনা, সে ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে। কিন্তু উত্থানপর্বে এ সবের কোনও কিছুই কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়নি সুদীপ্তের সামনে। বরং প্রভাব বাড়তে থাকে। তখন বাম আমল। কোম্পানির রবরবা দেখে স্থানীয় বেশ কিছু ‘দাপুটে’ সিপিএম নেতার আনাগোনা শুরু হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, রোজ সন্ধের পরে বিষ্ণুপুরের ওই সব নেতার আড্ডা হয়ে উঠত উঠত সারদা গার্ডেন। সঙ্গে আসতেন পুলিশের উঁচুদরের কিছু অফিসার। কোম্পানির কর্তাদের সঙ্গে নেতা-পুলিশের গা ঘষাঘষি এলাকাবাসীর নজর এড়ায়নি। অতএব বেআইনি দখলদারির বিরুদ্ধে কোনও চাষি পুলিশ-প্রশাসনের কাছে নালিশ জানানোরও সাহস পাননি।
ঠিক সিনেমায় যেমন হয়!
সারদা গার্ডেনের কিছু দূরে এক চায়ের দোকানের মালিক বলেন, “ভাসা মৌজায় আমার তিন বিঘে জমি ছিল। ২০০১-এ সারদার গুন্ডারা তা হাতিয়ে নিল। তিন বিঘের দাম পেলাম সাকুল্যে ৯০ হাজার টাকা। বাজারদর তখন কাঠাপিছু প্রতি তিন লাখ।” তিন বিঘে মানে ৬০ কাঠা। অর্থাৎ, ১ কোটি ৮০ লাখের জমির বদলে ৯০ হাজার! “ওদের সঙ্গে তো এঁটে উঠতে পারতাম না। তাই ওতেই রাজি হয়ে গেলাম। না-হলে কিছুই পেতাম না। উপরন্তু খুন হয়ে যেতে পারতাম।” ভরদুপুরে খরিদ্দার সামলানোর ফাঁকে মাথা চাপড়ালেন প্রৌঢ়।
ওঁরই মতো অবস্থা এলাকার বহু চাষির। সারদা গার্ডেনের চোখরাঙানির সামনে নিজেদের রুজি-রুটির অবলম্বন যাঁরা নামমাত্র মূল্যে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ২০০২-এর পরে বিষ্ণুপুরে জমির দর ক্রমশ বাড়তে থাকে। তত দিনে হাজার বিঘে সুদীপ্তের পকেটে। এখন তাঁর কর্মীদেরই কেউ কেউ বলছেন, ওই সময়ে সারদার জমি-খরিদ কারবারে কালো টাকা ঢেলেছিলেন স্থানীয় কিছু নেতা ও পুলিশের হোমড়া-চোমড়া।
বস্তুত সেই সুবাদে নিজে এক পয়সাও লগ্নি না-করে সুদীপ্ত সেন হাজার বিঘে জমির মালিক হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ। তাঁর সংস্থা ওখানে ফ্ল্যাট বানিয়ে বেচতে শুরু করে। যেগুলোর বৈধতা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। সারদা গার্ডেনের এক কর্তার কথায়, “অধিকাংশ জমি গায়ের জোরে নেওয়া। কোনও কাগজপত্র নেই। তাই খদ্দেরদের দলিল দেওয়া যায়নি। ওই সব সম্পত্তির নামপত্তনও করা যায়নি। কোম্পানি ক্রেতাদের শুধু একটা করে সার্টিফিকেট দিয়েছে।”
অভিযোগ রয়েছে আরও। যেমন একই ফ্ল্যাট একাধিক ক্রেতাকে বিক্রি, ন্যূনতম পরিষেবার ব্যবস্থা না-রাখা, আবাসিকদের উপরে জুলুমবাজি ইত্যাদি। সারদা গার্ডেনের ওই কর্তা বলেন, “অনেক জায়গায় পানীয় জল বা নিকাশির বন্দোবস্ত করা হয়নি। তার উপরে হরেক উৎসবে পীযূষ-প্রশান্তের দলবলের চাঁদার উৎপাত। অনেকে ফ্ল্যাট বেচে চলে যেতে চেয়েও পারেননি।” কেন? ওঁর অভিযোগ: পীযূষ-প্রশান্তের ‘অনুমতি’ ছাড়া বাইরের কাউকে ফ্ল্যাট বিক্রির অধিকার বাসিন্দাদের ছিল না। “তাই অনেকে বাজারদরে কেনা ফ্ল্যাট ওদের কাছেই জলের দরে বিক্রি করে পাততাড়ি গুটিয়েছেন।” জানাচ্ছেন তিনি। পীযূষ-প্রশান্তের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে লাভ হয়নি। কয়েক দিন হল নস্কর জুটি এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছে বলে জানাচ্ছেন বাসিন্দারা।
স্থানীয় সূত্রের খবর, এ ভাবে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে ২০০৬-এ ‘সারদা রিয়েলটি ইন্ডিয়া’ নামে অর্থলগ্নি সংস্থা চালু করেন সুদীপ্ত। ২০০৮-এ বিষ্ণুপুর বিধানসভা কেন্দ্রে মদন মিত্র বিপুল ভোটে জয়লাভ করার পরে ওই তল্লাটে সিপিএম কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে। আর তখন থেকেই সারদা গার্ডেনে সিপিএম নেতাদের বদলে তৃণমূল নেতাদের কারও কারও আনাগোনার সূচনা বলে অভিযোগ। সিপিএম বা তৃণমূল নেতৃত্ব কী বলছেন?
সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, “আমাদের কোনও নেতা-কর্মী ওখানে যেতেন বলে শুনিনি। খোঁজ নেওয়া হবে।” আর পরিবহণমন্ত্রী মদনবাবুর দাবি, “বহু লোক তো আমার কাছে আসতেন। কার কী উদ্দেশ্য, জানব কী করে?” নেতা-মন্ত্রীরা ‘না-জানলেও’ বিচক্ষণ সুদীপ্ত নিজের উদ্দেশ্য খুব ভাল ভাবে জানতেন বলে সারদা সংস্থার কর্মীদের একাংশের অভিমত। ওঁদের বক্তব্য, সুদীপ্ত তত দিনে আঁচ পেয়ে গিয়েছিলেন যে, রাজ্যে পালাবদল ঘটতে চলেছে। তাই ধীরে ধীরে তৃণমূলের রাজ্যস্তরের কিছু নেতার সঙ্গে তিনি ‘সুসর্ম্পক’ গড়ে তোলেন। “ভোটের খরচ হোক বা ব্যক্তিগত প্রয়োজন কিছু নেতাকে টাকা জোগাতে সেন সাহেব কখনও পিছপা হতেন না।” মন্তব্য এক কর্মীর। সারদা গার্ডেনের এক কর্তা বলেন, “কোন মুনি কোন মন্ত্রে সন্তুষ্ট, তা বুঝতে সেন সাহেবের দেরি হতো না। পুুলিশের অনেক বড়কর্তা তো বটেই, ছোট-মেজ-সেজ, সব ধরনের অফিসারের সঙ্গে দহরম-মহরম রাখতেন। প্রয়োজনের সব জায়গায় নিয়মিত ভেট পাঠাতেন।”অতএব, সারদার বিজয়রথের গতি অব্যাহত থাকে। চোদ্দো বছর ধরে তা মসৃণ গতিতে চলেছে। অমরীশ-প্রেম-শক্তির মোকাবিলায় আবির্ভূত হননি কোনও অমিতাভ বচ্চন বা ধর্মেন্দ্র। বরং অবাস্তব ও মিথ্যের বুনিয়াদে গড়ে তোলা সাম্রাজ্য নিজের কৃতকর্মের ভারে নিজেই ভেঙে পড়েছে। সিনেমায় যেমন হয় না!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.