সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উপরে চাপ আরও বাড়ল। এক দিকে, কংগ্রেস-শাসিত অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ ঘোষণা করেছেন, তাঁর রাজ্যে সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সমস্ত অভিযোগের সিবিআই তদন্ত হবে। অন্য দিকে, মমতার নিজের রাজ্যে বিরোধী বামেদের সন্দেহ, সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন সিবিআই-কে যে চিঠি দিয়েছেন, তা আসলে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বই লিখিয়েছেন। ফলে সারদা-কাণ্ডের তদন্ত রাজ্য করলে তা নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য হবে না বলেই বামেদের দাবি। তাঁরা সিবিআই-সহ কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে দিয়ে তদন্ত করানোর কথা বলেছেন।
সিবিআই ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করেছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার চাইলে সারদা-সহ ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির কাজকর্ম নিয়ে তদন্ত করতে পারে তারা। পশ্চিমবঙ্গের আগে সেই সুপারিশই করেছে অসম। গগৈ বলেছেন, “রাজ্যে চিটফান্ডগুলি যে ভাবে মানুষ ঠকাচ্ছে, তা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। ঘটনার গুরুত্ব বিচার করে সিবিআই-কে তদন্তভার নিতে বলছি।”
এই বিষয়ে বুধবার স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তা ও অসম পুলিশের ডিজি জয়ন্তনারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন গগৈ। এই সংক্রান্ত তদন্তের স্বার্থে ডিজি-কে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও নির্দেশ দিয়েছেন গগৈ। জয়ন্তবাবু বলেন, “সুদীপ্ত সেনকে জেরা করার প্রয়োজন হলে আমরা পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কাছে সাহায্য চাইব।”
গগৈয়ের মতে, শুধু মানুষের টাকা লোপাট করা নয়, অসমের রাজনীতিতেও নাক গলাতে শুরু করেছিল ওই সংস্থাগুলি। তাঁর অভিযোগ, বিরোধী নেতারা সারদার মতো সংস্থাগুলিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছিলেন। তবে কংগ্রেসের বেশ কিছু নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়েই অসমে সুদীপ্তবাবুর ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল বলেও অভিযোগ। কিন্তু তা সত্ত্বেও গগৈ যে ভাবে সিবিআই-কে তদন্তের দায়িত্ব দিলেন, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারও কেন তা করবে না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। |
বস্তুত, সারদা-কাণ্ডে শাসক তৃণমূলের একাধিক নেতা-মন্ত্রীর নাম জড়িয়েছে, তাতে রাজ্য সরকারের নিজস্ব তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে বাম ও কংগ্রেস শিবির। প্রদেশ কংগ্রেস আগেই সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী তথা কংগ্রেস সাংসদ দীপা দাশমুন্সি আজ বলেন, “রাজ্য সরকারের তদন্ত হলে সবটাই নিজেদের হাতে থাকবে। রেখে-ঢেকে, অন্যদের ফাঁসিয়ে রিপোর্ট তৈরি করা যাবে!” দীপা অবশ্য মমতার সরকারকে ‘সাবধান’ করে দিয়ে বলেছেন, রাজ্য না-চাইলেও সেবি নিজেই সিবিআই তদন্তের সুপারিশ করতে পারে। সিবিআই তদন্ত চেয়ে কলকাতা হাইকোর্টে যে জনস্বার্থ মামলাও দায়ের হয়েছে। ঘটনাচক্রে আজ, বৃহস্পতিবারই তার শুনানি হওয়ার কথা।
অসমের মুখ্যমন্ত্রীও মনে করছেন, শুধু তাঁর রাজ্যে সিবিআই তদন্ত করে সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হবে না। তাঁর যুক্তি, পড়শি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ওই ধরনের সংস্থা সক্রিয় থাকলে অসমে সমস্যা নির্মূল করা যাবে না। এই ব্যাপারে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের কাছেও রিপোর্ট জমা দিয়েছেন তিনি।
সুর চড়িয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বাম নেতারাও। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেছেন, “স্বাধীনতা-উত্তর কালে এটা পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম কেলেঙ্কারি। শাসক দল ও সরকার তাতে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। কেন্দ্রীয় ও অন্যান্য রাজ্য সরকারকে যৌথ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। সিবিআই-কে দরকার। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সেবি, এসএফআইও-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকেও যুক্ত করা প্রয়োজন। রাজ্য সরকারের তদন্ত বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না!”
সিবিআই-কে লেখা সুদীপ্তবাবুর চিঠির যে অংশ সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তাতে এখনও পর্যন্ত তৃণমূলের দু’জন সাংসদের দিকেই আঙুল উঠেছে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী-সহ তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের মদতেই সারদার রমরমা হয়েছিল বলে বামেদের অভিযোগ। সূর্যবাবুর কথায়, “এটা পরিষ্কার যে, এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে যে ব্যক্তি যুক্ত, তিনি সততার প্রতীকের (মুখ্যমন্ত্রী) নাম ব্যবহার করেছেন। যে নেতা বা সাংসদদের নাম আসছে, তাঁরাও সেই প্রতীকই কাজে লাগিয়েছেন! মুখ্যমন্ত্রীর ‘কাছের লোক’ হিসেবেই কিছু ব্যক্তির কথা চিঠিতে বলা হয়েছে। অভিযুক্ত প্রতারক ও শাসক দলের যোগাযোগ রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।”
সূর্যবাবুর অভিযোগ, পারিপার্শ্বিক ঘটনায় মনে হচ্ছে, তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ওই চিঠি লেখার সময় উপস্থিত ছিলেন। নিজেরা বাঁচার জন্য তৃণমূল সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ও সারদা গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে শাসক দলের কয়েক জনকে বলির পাঁঠা করা হচ্ছে কি না, তারও তদন্ত চেয়েছেন বিরোধী দলনেতা। তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের নাম জড়াচ্ছে বলে জনহিতার্থে প্রয়োজনে যৌথ সংসদীয় কমিটির (জেপিসি) কথাও বলেছেন তিনি।
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য পাল্টা বলছেন, এক জন প্রতারকের চিঠিকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে? সূর্যবাবুর পাল্টা বক্তব্য, প্রতারক বা অভিযুক্তও ১৬১ বা ১৬৪ ধারা অনুযায়ী কিছু জানাতে চাইতে পারেন। চিঠিটি তিনি লিখেছেন, না তাঁকে দিয়ে লেখানো হয়েছে, এ সব প্রশ্নের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দরকার কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে।
তবে সর্বভারতীয় স্তরেই যখন তৃণমূলের উপরে চাপ বাড়ছে, তখন জাতীয় রাজনীতির সমীকরণ মাথায় রেখেই মমতার বিরুদ্ধে বিশেষ আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে চাননি বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। দলের মুখপাত্র প্রকাশ জাভড়েকর শুধু এটুকুই বলেছেন, “আমরা চাই, গোটা ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। আর এই ঘটনার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত লাখো লোকের পয়সাও ফেরত দিক সরকার।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ সিবিআই তদন্ত দাবি করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে যেমন সারদার মতো সংস্থার সঙ্গে যোগসাজশ নিয়ে শাসক-বিরোধী চাপানউতোর চলছে, অসমের রাজনীতিও তার ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন শহরে সারদা গোষ্ঠীর দফতরে ভাঙচুর চলছে। অভিযোগ উঠেছে, সুদীপ্তবাবুর সঙ্গে রাজ্যের ক্ষমতাশালী মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি শঙ্কর বরুয়ার আঁতাঁত ছিল। হিমন্তের স্ত্রীর মালিকানাধীন একটি টিভি চ্যানেলের জন্য টাকা চেয়ে সুদীপ্তবাবুকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। সেই চিঠি এবং হিমন্ত-শঙ্করের সঙ্গে সুদীপ্তবাবুর কথাবার্তার রেকর্ডও ফাঁস হয়ে গিয়েছে। হিমন্ত অবশ্য এই সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। গগৈ চাইছেন, সিবিআই তদন্তে সব তথ্যই উঠে আসুক। সিবিআই তদন্তের মতো আরও একটি বিষয়ে মমতা সরকারের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছেন গগৈ। আমানত-কারীদের স্বার্থ রক্ষায় মার্চেই ‘দ্য অসম প্রোটেকশন অফ ইন্টারেস্ট অফ ডিপোজিটর্স ইন ফিনান্সিয়াল এস্টাব্লিশমেন্টস’ সংশোধনী বিল বিধানসভায় পাশ হয়ে গিয়েছে। এই আইন কার্যকর হলে কোনও লগ্নিকারী সংস্থা প্রতারণা করলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। দোষীদের ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও ১০ বছর অবধি কারাদণ্ড হবে। |