বেসরকারি ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থায় জমার পরিমাণ যত বেড়েছে, ততই কমেছে সরকারি নিশ্চয়তা থাকা বিভিন্ন স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি সঞ্চয় প্রকল্পের মোট আমানত। শুধু মাত্র জলপাইগুড়ি জেলায় গত আড়াই বছরে ডাক ঘরের সঞ্চয় প্রকল্পগুলিতে প্রায় ৪০৯ কোটি টাকার লগ্নি কমেছে। গত দু’বছরে রাজ্য জুড়ে একের পর এক বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থা গজিয়ে ওঠার কারণে আমানতে ঘাটতি বলে মনে করছেন ডাকঘর কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট অফিসারদের একাংশের অনুমান, ডাকঘরের নিশ্চিত জমা প্রকল্প থেকে টাকা তুলে, চড়া সুদের প্রলোভনে সাধারণ আমানতকারীরা লগ্নি করেছে ভুঁইফোঁড় বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থায়।
স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি মিলিয়ে মোট আটটি সঞ্চয় প্রকল্প চলে ডাকঘরগুলিতে। ডাক বিভাগের জলপাইগুড়ির বিভাগীয় দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সব কটি প্রকল্প মিলিয়ে ২০১০-১১ সালের আর্থিক বছরের শেষে ডাক বিভাগে সাধারণ আমানতকারীদের লগ্নির পরিমাণ ছিল প্রায় ৯০৮ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। চলতি বছরের শুরুতে সেই পরিমাণ কমে দাড়িয়েছে প্রায় ৪৯৯ কোটি ১৫ লক্ষ টাকায়। গত দু’বছরে প্রায় ৫৮ হাজার আমানতকারী মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই তাদের আমানত তুলে নিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। যে সব আমানতকারীর মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে তাঁরাও নতুন করে ডাকঘরে আমানত রাখেননি। জলপাইগুড়ি প্রধান ডাকঘরের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক দীনেশ দাস বলেন, “গত দু’বছর ধরেই ডাকঘরের সঞ্চয় প্রকল্পগুলিতে মন্দা শুরু হয়েছে। অনেক আমানতকারী মাঝপথে টাকা তুলে নিয়ে গিয়েছেন। বেশি সুদের আশায় ভুঁইফোঁড় অর্থ সংস্থাগুলিতে লগ্নি করেছেন।” |
আমানতের সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা থাকা সরকারি প্রকল্পে কেন ভাটার টান?
কেন্দ্রীয় সরকারের দুটি সার্টিফিকেট প্রকল্প রয়েছে ডাক বিভাগের. ৫ বছর টাকা জমা রাখার সরকারি সার্টিফিকেট প্রকল্পে সুদের পরিমাণ ৮.৬ শতাংশ এবং ১০ বছরের প্রকল্পে সুদ ৮.৯ শতাংশ। জলপাইগুড়িতে বছর দুয়েক আগে অফিস তৈরি করা সারদা গোষ্ঠীতে ৫ বছর টাকা রাখলে একশো শতাংশ সুদ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। অর্থাৎ ৫ বছরে টাকা দ্বিগুণ। ১০ বছর টাকা রাখলে সুদের পরিমাণ দেড়শ শতাংশ বলা হয়েছিল।
শুধু সারদা গোষ্ঠীই নয়, শহরের বাবুপাড়া, পাণ্ডাপাড়া, দিনবাজারের অফিস থাকা বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি ৫ বছরে টাকা দ্বিগুণের পাশাপাশি প্রতি মাসে টাকা জমা দেওয়ার প্রকল্পে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ সুদ দেওয়ার আশ্বাস দেয়। সেখানে ডাকঘরের মাসিক জমা প্রকল্পে সুদের মাত্র সাড়ে ৮ শতাংশ। জলপাইগুড়ি ডাক বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, এক বছরের বেশি সময়ের দীর্ঘমেয়াদি জমা প্রকল্পে ২০১১ সালে প্রায় ৯৬ হাজার আমানতকারী অর্থলগ্নি করেন। চলতি বছরে সেই সংখ্যা কমে হয়েছে ৫০ হাজারের কাছাকাছি। সরকারি সূত্রের খবর, প্রায় ৩৫ হাজার আমানতকারী মাঝপথে সঞ্চয় ভেঙে টাকা তুলেছেন। নিম্ন আয়ের ব্যাক্তি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য রেকারিং জমা প্রকল্পেও গত দু’বছরে মন্দার ছায়া। ২০১০-এ ডাকঘরের রেকারিং জমা প্রকল্পে প্রায় ৫৪ হাজার আমানতকারী টাকা জমা রাখেন। চলতি বছরে সেই সংখ্যা কমে হয়েছে ৩১ হাজার, প্রায় ২৩ হাজার আমানতকারী তাদের ডাকঘরের রেকারিং জমা বন্ধ করে দিয়েছেন।
জলপাইগুড়ি জেলার বিভাগীয ডাকঘরের অধীনে আলিপুরদুয়ার ডাকঘরের শাখা নেই। কোচবিহার ও দার্জিলিং জেলার তিনটি ডাকঘর নিয়ে এই বিভাগের কাজকর্ম চলে। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব গ্রামীণ ব্যাঙ্কের আর্থিক উপদেষ্টা তথা আয়কর আইনজীবী মিহির বন্দোপাধ্যায় বলেন, “একদিনে কিন্তু এই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। বহু গরিব মানুষ ভুল বুঝে সরকারি প্রকল্পের টাকা তুলে নিয়ে ভুঁইফোঁড় সংস্থায় ঢেলেছেন। আমরা আমাদের মত প্রচার চালিয়েছি। কিন্তু সরকারের উচিত ছিল, সাধারণ মানুষকে সর্তক করে দেওয়া। সেটি ভাল ভাবে না হওয়াতেই বিপত্তি হয়েছে।” |