ধীরে ধীরে বাড়ছে এসিবি।
মুখ্যমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকা এসিবি বা রাজ্যের দুর্নীতি দমন শাখার তদন্তের এক্তিয়ার বাড়ানো হচ্ছে। এত দিন শুধু সরকারি কর্মীদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করতে পারত ওই সংস্থা। আজ, মঙ্গলবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে যে-প্রস্তাব পাশ হওয়ার কথা, তাতে যাঁরা ‘জনসাধারণের কাজ’ করেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির তদন্তের অধিকার দেওয়া হচ্ছে এসিবি-কে।
ওই অধিকার দেওয়ার জন্য এসিবি-র তদন্তের এক্তিয়ার সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে সংশোধনী আনছে রাজ্য সরকার। গত ২ অগস্ট কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, সরকারি ও আধা-সরকারি সংস্থা, পুরসভা, পঞ্চায়েত ও সমবায়ের যে-সব কর্মী রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন, দুর্নীতি দমন শাখা কেবল তাঁদের বিরুদ্ধে খোঁজখবর নেবে। পরে এসিবি-কে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের অধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের তদন্তের এক্তিয়ারে বদল ঘটানো হয়নি।
কী থাকছে সংশোধনীতে?
মহাকরণ সূত্রের খবর, প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, যাঁরা সরকারের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে থেকে ‘পাবলিক ডিউটি’ বা জনসাধারণের কাজ করেন (যাঁদের বেতন, সাম্মানিক ও ভাতা সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হয়), তাঁরা এসিবি-র তদন্তের আওতায় পড়বেন। যাঁরা ‘লোকাল অথরিটি’ বা স্থানীয় প্রশাসন থেকে বেতন নেন, তদন্তের এক্তিয়ারে পড়বেন তাঁরাও। অফিস খুলে বসে পদাধিকারবলে যাঁরা জনসাধারণের কাজ করেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির তদন্ত করতে পারবে এসিবি।
কারা জনসাধারণের কাজ করেন?
প্রশাসনের একটি অংশের ব্যাখ্যা, যে-কোনও জনপ্রতিনিধিই আমজনতার স্বার্থে কাজ করেন। তিনি পঞ্চায়েতের প্রধান, জেলা পরিষদের সভাধিপতি, পুরসভার চেয়ারম্যান কিংবা নিছক কাউন্সিলরও হতে পারেন। বিধায়কেরাও জনস্বার্থে কাজ করেন বলেই তাঁদের মত। ওই অংশের বক্তব্য, বিধায়কদের মধ্য থেকেই মন্ত্রী বাছা হয়। সরকারি তহবিল থেকে তাঁদের বেতন দেওয়া হয় এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণেই কাজ করেন তাঁরা। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “বিভিন্ন সমবায়ের রাজনৈতিক পদাধিকারীরাও সংশোধনীর আওতায় আসবেন।”
এই ব্যাখ্যা অবশ্য মানতে চাননি প্রশাসনের অন্য একটি অংশ। তাঁরা বলছেন, জনসাধারণের কাজ করলেও মন্ত্রীরা ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ বা সরকারি চাকুরে নন। বিধায়কেরাও নন। বিধানসভার তহবিল থেকে তাঁদের ভাতা দেওয়া হয়। তাই আগের বিজ্ঞপ্তির সংশোধন সত্ত্বেও বিধায়ক-মন্ত্রীরা এসিবি-র তদন্তের আওতায় পড়বেন না বলে রাজ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তার অভিমত।
তবে কমিশনের পদাধিকারী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের এই সংশোধনীর বাইরে রাখা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ওই দু’টি সংস্থা স্বশাসিত এবং তারা সরকারের সরাসরি প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই সেখানকার পদাধিকারীরা এসিবি-র তদন্তের আওতায় পড়বেন না। বাদ রাখা হয়েছে এই রাজ্য থেকে নির্বাচিত সাংসদদেরও।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে যে-উদ্দেশ্যে ওই সংস্থা তৈরি হয়, আগের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী পরবর্তী কালে তাতে কিছু সীমাবদ্ধতা ধরা পড়ে। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের একাধিক কর্তার প্রশ্ন, সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থায় রাজনৈতিক পদাধিকারীরা এক জন অফিসারের চেয়ে কম ক্ষমতা ভোগ করেন না। অনেক সময় তাঁদের মতই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। সে-ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগে শুধু সরকারি কর্মীদের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে কেন? যে-জনপ্রতিনিধিকে সরকারি অফিসারের মাথায় বসানো হয়েছে, তিনি কি দুর্নীতির দায় এড়াতে পারেন?
এই টানাপোড়েনের মধ্যেই বেশ কিছু পুরসভার চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও পঞ্চায়েত প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে। সেগুলি এসিবি-র কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হলে ওই তদন্তকারী সংস্থার তরফে জানানো হয়, তাঁরা ওই সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করতে অপারগ। কারণ, এসিবি-র তদন্তের আওতায় জনপ্রতিনিধিদের রাখা হয়নি। মহাকরণ সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কানে সেই খবর পৌঁছনোর পরেই তিনি ওই বিজ্ঞপ্তি সংশোধনের নির্দেশ দেন।
প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, আট ঘাট বেঁধেই এসিবি-কে পুরোদমে কাজ শুরুর সুযোগ দিতে চলেছে রাজ্য সরকার। ২ অগস্টের বিজ্ঞপ্তিতে শুধু অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে খোঁজখবর নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল দুর্নীতি দমন শাখাকে। পরে অবশ্য ওই সংস্থার আর্জি মেনে নব মহাকরণে এসিবি-র অফিসকে পৃথক থানা হিসেবে ঘোষণা করে রাজ্য সরকার। সেই ঘোষণা-বলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এফআইআর করা, গ্রেফতার করার ক্ষমতা পায় এসিবি। ওই সংস্থার এক কর্তা বলেন, “সিবিআইয়ের ধাঁচে এসিবি-কে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ওই কেন্দ্রীয় সংস্থার একাধিক প্রাক্তন কর্তার কাছে আমাদের অফিসারেরা দফায় দফায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তদন্তের এক্তিয়ার বাড়লে পুরোদস্তুর কাজ শুরু করে দেওয়া যাবে।”
একই সঙ্গে পৃথক আদালতেরও আর্জি জানিয়েছে এসিবি। আইন ও বিচার দফতরের কাছে আর্জিতে তারা বলেছে, ‘সিবিআইয়ের নিজের কোর্ট আছে। আইনজীবীও আছে। ফলে বহু ক্ষেত্রে আইনি লড়াইয়ে এগিয়ে যায় তারা। এসিবি-র জন্যও পৃথক কোর্ট চেয়েছি আমরা।’ এক এসিবি-কর্তা বলেন, “সরকারি আইনজীবীরা একসঙ্গে অনেক মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। নিজেদের আইনজীবী থাকলে তাঁকে মামলা বোঝানো সহজ হয়। তিনিও শুধু এসিবি-র মামলায় মনঃসংযোগ করতে পারেন।”
মহাকরণ সূত্রের খবর, এসিবি-র আর্জি মেনে আলাদা কোর্ট তৈরির প্রক্রিয়াও শেষের মুখে। |