দুই দল যুযুধান ছাত্রের রণাঙ্গন হওয়া, এবং তার জেরে নানা নেপথ্য অনাচার
ও
দুর্নীতির
লীলাক্ষেত্র হওয়াই যে আমাদের শিক্ষায়তন মাত্রের ভবিতব্য নয়,
এ ধারণাটা অন্তত
চিন্তার আওতায় এসেছে। আপাতত এটুকুই ভরসার কথা। সুকান্ত চৌধুরী |
ছাত্রনীতি নিয়ে অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের লেখার (৯-৪) জবাবে একটা প্রবন্ধ (১৪-৪) লিখেছিলাম। সেটার জবাবে (১৮-৪) তিনি লিখেছেন আর একটি প্রবন্ধ, যার শেষে সরাসরি আমার উদ্দেশে একটা প্রশ্ন আছে। তাঁর দ্বিতীয় প্রবন্ধ থেকে আরও কিছু প্রশ্ন উঠে আসে; তার প্রত্যুত্তরে আজকের এই লেখা।
পার্থদার প্রথম যুক্তি: ছাত্রেরা বয়স্কদের ক্রীড়নকে পরিণত হচ্ছে, এই দোহাইয়ে যদি তাদের রাজনীতিচর্চা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তবে তা তরুণ সমাজের সবার ক্ষেত্রে করতে হয়, ভোটাধিকারের বয়সটাই বাড়িয়ে দিতে হয় শেষ অবধি। পার্থদা মাপ করবেন, ‘রাজনীতি’ শব্দের দুই পৃথক প্রয়োগ এক করে, বৃহত্তর সমাজবোধ ও নাগরিক দায়িত্বের সঙ্গে সংকীর্ণ, প্রায়ই ধ্বংসাত্মক দলীয় কর্মকাণ্ডকে মিলিয়ে ফেলার যে প্রবণতা আমার আগের প্রবন্ধে চিহ্নিত করেছিলাম, এই যুক্তির পিছনে কি তার একটু রেশ দেখা যাচ্ছে? আরও বড় কথা, ছাত্রদের মধ্যে হানিকর দলীয় রাজনীতির পত্তন করা, ও সেই উদ্দেশ্যে তাদের ব্যবহার করা যত সহজ, যুবসমাজের অন্য অংশের মধ্যে ততটা নয়।
ছাত্রেরা এমনিতেই একটা চত্বরে একত্রিত হয়ে থাকে, তাই তাদের সংগঠিত করা সহজ। তারা কোনও অপরাধ করলে, বিশেষত শিক্ষা প্রাঙ্গণের পরিসরের মধ্যে, আইনের হাত থেকে তারা একদা সর্বতোভাবে ও এখনও বহুলাংশে মুক্ত। গরিব ছাত্রদের কিছু রোজগার করতে হয়, হয়তো বা সংসারের ভার মাথায় নিতে হয়, কিন্তু সাধারণ ভাবে ছাত্রেরা জীবিকার দায় থেকে মুক্ত, রাজনীতিতে বেশি সময় দিতে পারে। অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত ও মেধাবী বলে তাদের মধ্য থেকে প্রাথমিক পর্যায়ের এক সারি নেতা খাড়া করা যায়, যাদের কেউ কেউ পরে দলের উচ্চতর নেতৃমণ্ডল সমৃদ্ধ করে। এ সব কারণে ছাত্র-রাজনীতি প্রায়ই যত প্রবল হয়ে ওঠে, অন্য কোনও যুব-রাজনীতি তার কাছাকাছি যেতে পারে না।
একই কারণে ছাত্রদের সদর্থক রাজনীতি যতটা ফলপ্রসূ হতে পারে, তার বিকৃত বিধ্বংসী রূপ হয় ততটাই ক্ষতিকারক। শিক্ষার মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ক্ষেত্র তার ফলে বিপন্ন হয়ে পড়ে। |
‘সারস্বত জীবনের আসল মূল্য ক্যাম্পাস-রাজনীতিতে নয়, অন্যত্র।’
ভর্তির জন্য। প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা। ছবি: অমিত দত্ত |
পার্থদার দ্বিতীয় যুক্তিটা ঠিক বুঝলাম না। আমি আক্ষেপ করেছিলাম, বিরোধসর্বস্ব রাজনীতির ফলে যৌবনের স্বাভাবিক মানবিকতা ও সমাজবোধ হারিয়ে যায় হিংসা ও বিদ্বেষের গহ্বরে। পার্থদার প্রশ্ন: কেন, হিংসা-বিদ্বেষও কি মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি নয়? স্বাভাবিক হতে পারে, বাঞ্ছনীয় অবশ্যই নয়। আমাদের অনেক ভাল-মন্দ স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে, ভালগুলিকে লালন করা ও মন্দগুলিকে সংযত করাই তো শিক্ষা ও সামাজিকীকরণের লক্ষ্য। কোনটা ভাল কোনটা মন্দ, তা নিয়ে মানুষে-মানুষে সমাজে-সমাজে প্রবল মতভেদ আছে, কিন্তু হিংসা-বিদ্বেষকে সচরাচর মন্দের ভাগেই ফেলা হয়। পার্থদা আমায় ভুল বুঝেছেন: আমি অপরের হিংসা-বিদ্বেষের থেকে সুকুমারমতি ছাত্র-সমাজকে আড়াল করার কথা বলিনি, তাদের নিজেদের মনেই হিংসা-বিদ্বেষের উন্মেষের কথা বলেছিলাম। তার ‘কারণ উপলব্ধি করা’ বা ‘মোকাবিলা করতে শেখা’ অবশ্যই জরুরি। নিজেরা হিংসায় লিপ্ত থাকলে তা সম্ভব নয়।
এর পর পার্থদা ঠিকই বলেছেন, অধিকাংশ ছাত্র এই দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়, হয়তো সমর্থনও করে না। এটাও ঠিক বলেছেন, তার মানে এই নয় যে তারা রাজনীতি সম্বন্ধে উদাসীন: এটুকুই বলা যায়, তারা শিক্ষাপ্রাঙ্গণে দলাদলি হানাহানির বাইরে থাকতে চায়। এই প্রত্যাখ্যানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ইতিবাচক সমাজবোধের বীজ।
কিন্তু তা থেকে কি এটাই প্রমাণিত হয় না, যে দলভিত্তিক ছাত্রনির্বাচন না হলে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের বড় অংশ কোনও ক্ষতি বা অভাব বোধ করবে না? এত সোজাসুজি বললে অবশ্য অতিসরলীকরণ হবে। স্বীকার করতেই হয়, সক্রিয় রাজনীতি করে না, এমন বিপুল সংখ্যক ছাত্র কলেজ নির্বাচনে ভোট দেয়। কখনও কখনও দেয় ভয়ে বা শাসানির ফলে। কিন্তু প্রায়শ দেয় অন্য কারণে: কোনও প্রার্থীর সঙ্গে বন্ধুত্ব বা ক্লাসতুতো সম্পর্কের খাতিরে, সাধারণ ভাবে কোনও রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে বলে, বা নিছক ছাত্রজীবনের একটা সাধারণ কর্তব্য হিসেবে, যেমন হয়তো হাজিরা দেয় অক্ষম অধ্যাপকের ক্লান্তিকর ক্লাসে। তবে যে কারণেই হোক, ভোট তারা দেয়। তাদের এই অধিকার আমরা খর্ব করি কী করে?
এ প্রসঙ্গে পার্থদার সতর্কবাণী বিশেষ জরুরি। আপত্কালীন অবস্থার দোহাই পেড়ে ছাত্রনির্বাচন সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখা কি একটা অসুস্থ নজির নয়? ক্রমে অন্যান্য ক্ষেত্রেও এমন হুকুম জারি করলে আমাদের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার কি বিপন্ন হয়ে পড়বে না?
এ বিষয়ে ভাবিনি, তা নয়। কিন্তু পার্থদা নতুন করে ভাবালেন। তবু শেষ অবধি বলব, চিন্তাটা বোধ হয় অমূলক। প্রথমত, পার্থদাই যা বলেছেন: এই নির্বাচনের আগে-পিছে যে রাজনৈতিক খেলা চলে, অধিকাংশ ছাত্রের তাতে সমর্থন নেই। বৃহত্তর প্রেক্ষিতে নির্বাচনটা যেন অবান্তর। তার চেয়েও বড় কথা— আমার আগের প্রবন্ধে যা বলেছিলাম— ছাত্রদের সদর্থক প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক বোধের বিকাশ ও কর্মসূচি এর ফলে থমকে পড়ে।
পার্থদা ঠিকই বলেছেন, সেটা ফের চালু হতে পারে প্রতিষ্ঠানের তাগিদে, সরকারি নির্দেশে নয়। অগ্রণী ভূমিকা অবশ্যই নিতে হবে কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকসমাজকে, যেমন বেসু-র উপাচার্য ও শিক্ষকমণ্ডলী দৃষ্টান্তমূলক ভাবে নিয়েছেন। স্বীকার করতেই হয়, এই প্রবন্ধকার-সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষক নিজেদের মাটিতে এমন কোনও সংস্কার আনতে পারিনি। প্রত্যক্ষ হিংসা বা অনাচার ঘটলে হয়তো অকুস্থলে গিয়ে তাত্ক্ষণিক মোকাবিলা করেছি; বড়জোর পঠনপাঠন ও পাঠ্যাতিরিক্ত কিছু উদ্যোগের মধ্য দিয়ে ছেলেমেয়েদের বোঝাবার চেষ্টা করেছি যে সারস্বত জীবনের আসল মূল্য ক্যাম্পাস-রাজনীতিতে নয়, অন্যত্র। আরও গঠনমূলক প্রচেষ্টার সম্ভাবনা হারিয়ে গেছে ব্যস্ততায় ও পরিপার্শ্বের আলোড়নে। এ দিকে অন্য কিছু বিদ্বজ্জন গবেষণা-প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ থেকে ছাত্রসমাজের সঙ্গে তেমন আদানপ্রদানের সুযোগই পাননি।
আলোড়ন মোটেই থেমে যায়নি। উপরন্তু শিক্ষকসমাজের একটা বড় অংশ সরাসরি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে যখন শুনি মুখ্যমন্ত্রী বলছেন অমুক বিশ্ববিদ্যালয় মেধা ও উত্কর্ষের স্বপ্নকেন্দ্র, অতএব তাঁর ছাত্র সংগঠনের সেখানে প্রবেশ নিষেধ। অস্যার্থ: অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে মেধা বা উত্কর্ষ নেই, গড়ে তোলার দরকারও নেই; সেখানে দলীয় রাজনীতি চলতেই পারে, শাসক দলও যজ্ঞে ঘৃতাহুতি দেবেন।
তাই খেদের সঙ্গে বলতে হয়, রাজ্য বা দেশ জুড়ে শিক্ষাজগতের যে আত্মিক পরিবর্তন পার্থদা চাইছেন, এ মুহূর্তে তা সত্যিই বোধ হয় অসম্ভব। তবু যদি কিছু দিন ছাত্রনির্বাচন বন্ধ থাকে, হয়তো খানিক হাঁপ ছাড়ার অবকাশ জুটবে, লোকে দেখার সুযোগ পাবে দলীয় রাজনীতিতে একটু ভাটা পড়লে শিক্ষায়তনগুলির ভাল হয় না খারাপ হয়। সত্যিই যদি অন্য রকম ব্যবস্থার উদ্ভাবন করতে হয়, তার ভিতের জন্য হয়তো ঘোলা জল সরে গিয়ে একটু শক্ত মাটি জেগে উঠবে।
কিছু না হোক, এ বিষয়ে যে একটা আলোচনা শুরু হয়েছে সেটাই ভরসার কথা। দুই দল যুযুধান ছাত্রের রণাঙ্গন হওয়া, ও তার জেরে নানা নেপথ্য অনাচার ও দুর্নীতির লীলাক্ষেত্র হওয়াই যে আমাদের শিক্ষায়তন মাত্রের ভবিতব্য নয়, এ ধারণাটা অন্তত চিন্তার আওতায় এসেছে। শেষ অবধি হয়তো দলীয় রাজনীতির ভিত্তিতেই ছাত্রনির্বাচন ও শিক্ষাজীবন পরিচালিত হতে থাকবে; কিন্তু তার ধারায় অন্তত কিছু রূপান্তর ঘটবে হয়তো। এর বেশি আশা করা এখনও স্বপ্নের পর্যায়ে; কিন্তু স্বপ্ন না দেখলেও যে চলে না।
|
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক |