প্রবন্ধ ২...
‘দিদি তোমার হাতটা দেখি, কোদাল মারো কি না’
য়স যখন সতেরো, তখন বাবা মারা গিয়েছিলেন। দমে না গিয়ে নিজেই চাষের কাজে নেমে পড়েছিল মেয়েটি। মাঠে মজুরেরা খাটত, মেয়েটিও খাটত। তাই দেখে ব্যঙ্গ করে জেঠতুতো দাদা বলেছিল, “চাষ করে কী হয়?” বোন উত্তর দিয়েছিল, “চাষ করে কী হয়, করে দেখাব।”
কোলাঘাটের ছন্দারানি করণ বাহান্ন বছর বয়সে ‘কৃষকরত্ন’ পুরস্কার পেলেন এ বছর। সার্টিফিকেটে বানান ভুল ছিল, তাই সেটা আবার লেখা হতে গিয়েছে। কিন্তু রত্নের আভা তাঁর চোখেমুখে। গল্প করছিলেন, “কলেজে ছেলেরা বলত, দিদি তোমার হাতটা দেখি, তুমি সত্যি কোদাল মারো কি না। কিন্তু নিজে কাজ না করে উপায় কি, বলো? একদিন ধানঝাড়ার কাজটা ছেড়ে দিলাম মজুরদের উপর। এক বিঘে জমির ধান ঝাড়া হল। পরদিন আমি নিজে মেশিন ধরলাম। দু’বিঘে জমির ধান ঝাড়া হল সেদিন।”
একই জমিতে যে দ্বিগুণ ধান ফলানো যায়, সে-ও করে দেখিয়েছেন ছন্দা। ‘শ্রী’ পদ্ধতিতে ধান চাষে বীজ লাগে অর্ধেকেরও কম, রুইতে হয় ফাঁকা ফাঁকা করে। “গ্রামের লোকে পাগল-ছাগল বলেছিল। ভাইয়ের সঙ্গেও অশান্তি হয়েছে।” এখন সরকারি কৃষিকর্তারা দূর থেকে চাষিদের দেখাতে নিয়ে আসেন ছন্দার খেত। ছন্দাকেও নিয়ে যান। “কাঁথি ৩, রামনগর ২, নন্দীগ্রামে নিয়ে গিয়েছি ছন্দাকে,” বললেন কোলাঘাটের কৃষি আধিকারিক নবকুমার বর্মন। বিঘে প্রতি দেড়শো কিলোগ্রাম অবধি বাড়তি ধান মিলছে ‘শ্রী’ পদ্ধতিতে, তা হাতে কলমে করে দেখাচ্ছেন ধুলিয়াড়া গ্রামের ছন্দারানি।
ঝাড়গ্রাম ব্লকের লালগড়ে তা করে দেখিয়েছেন আর এক ‘কৃষকরত্ন’। সাতাশ বছরের ফুলমণি হাঁসদা বড্ড জেদি বউ, বর ইন্দ্রজিতের সঙ্গে ঝগড়া করেই সাকুল্যে দু’বিঘে জমির দেড় বিঘেতে শ্রী পদ্ধতিতে ধান চাষ করেছিলেন। ভিডিয়োতে নতুন রকম চাষ দেখে উত্‌সাহিত ফুলমণি ইন্দ্রজিত্‌কে সাফ বলে দিয়েছিলেন, ফসল না হলে মজুর খেটে খাওয়াবেন দুই ছেলেকে। আট কিলোগ্রাম বীজের জায়গায় মাত্র ন’শো গ্রাম বীজে চাষ করেছিলেন। পেয়েছেন ডবল ধান। তাই দেখে অবাক ফুলমণির স্বনির্ভর দল ‘বিদু চাঁদান মহিলা গোষ্ঠী’র সোমবারি সরেন, রাঁধুনি মুর্মু, গোলাপি হাঁসদা। “স্বামীদের বলেছি, আগামী বর্ষায় শ্রী পদ্ধতিতেই চাষ করতে হবে,” বললেন তাঁরা।
একই জমিতে দ্বিগুণ ফসল। ছন্দারানি করণ। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস
এমন সাহস, এমন সাফল্যের গল্পই যদি মেয়েদের গল্প হত, কী ভালই না হত। কিন্তু হাসি আটকে যায় ঠোঁটের কোনায়। এ বছর ‘কৃষকরত্ন’ পেয়েছেন রাজ্যের প্রতি ব্লকে একজন চাষি। রাজ্যের ৩৪১টি ব্লকে পুরস্কার যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের ৩৩৯জন পুরুষ। মেয়ে মাত্র দু’জন, ছন্দারানি আর ফুলমণি।
অথচ চাষ করেন, ভারতে এমন মেয়ের সংখ্যা দশ কোটিরও বেশি। কৃষিকাজে দশজনে অন্তত চারজন মহিলা। আর, চাষের কাজে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে ঢের বেশি সময় দেয়। একনাগাড়ে, একঘেয়ে পরিশ্রমের কাজগুলো তারাই করে। নানা রাজ্যে কৃষিতে পুরুষ ও মহিলাদের কাজ লক্ষ করে দেখা গিয়েছে, চারা রোপণ, ‘নিড়েন দেওয়া’ (আগাছা ওঠানো), ফসল কাটা, ঝাড়াই, এই কাজগুলো মেয়েদের একচেটিয়া। রাজস্থানে, মধ্যপ্রদেশে, মহারাষ্ট্রে গবেষকরা দেখেছেন, বাড়ির মেয়ে আর মেয়ে-মজুর মিলিয়ে চাষের মোট শ্রমের অর্ধেকেরও বেশি করে মেয়েরাই। ফলের বাগান, বাদাম বা তুলোর চাষে শ্রমের বেশির ভাগটাই করে তারা। তবে তার প্রায় সবটাই ‘উন্নত’ দক্ষতার কাজ নয়, ঘাড় ঝুঁকিয়ে-পিঠ বাঁকিয়ে কঠোর শ্রম। ট্র্যাক্টর, পাওয়ার টিলারের মতো আধুনিক প্রযুক্তি যেটুকু এসেছে, তার পুরোটাই পুরুষদের দখলে। মেয়েদের রোজগারও তাই কম।
ঘরের মেয়েরা খাটে মিনিমাগনায়, মজুর মেয়েরাও টাকা পায় পুরুষদের তুলনায় কম।
আরও একটা কারণে মেয়েরা ‘চাষি’ না হয়ে ‘চাষিবউ’ হয়ে রয়ে যায়। তা হল জমির মালিকানা। জমি না থাকলে মেলে না ‘চাষি’ স্বীকৃতি। গোটা রাজ্যে যত কিষান ক্রেডিট কার্ড রয়েছে, তার কতগুলি মেয়েদের নামে, কৃষি সমবায়ের সদস্যদের মধ্যে কত মেয়ে রয়েছেন, কেউ খবর রাখে না। অগত্যা খোঁজ করা গেল পূর্ব মেদিনীপুরের নানা সমবায়ে। সুতাহাটা ব্লকের টাবাখালি সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতির সভাপতি আনন্দময় অধিকারী জেলা পরিষদেরও সদস্য। বললেন, “টাবাখালি সমবায় সমিতির অধীনে চারটি গ্রাম মিলিয়ে মোট ১৭০ জন সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে মাত্র ১২ জন মহিলা। এঁদের কিষান ক্রেডিট কার্ড আছে, চাষের জন্য ঋণও নিয়েছেন। তবে সদস্য সংখ্যার তুলনায় মহিলাদের সংখ্যা বেশ কম।” কোলাঘাট ব্লকের বরদাবাড় সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতির যুক্ত সাগরবাড় গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান সুরজিত্‌ মাইতি স্বীকার করেন, “আমাদের কৃষি সমবায় সমিতিতে প্রায় দু’হাজার সদস্য। তবে কৃষিখাতে ঋণ নেওয়া মহিলা সদস্যের সংখ্যা খুবই কম। কারণ, মেয়েদের নামে জমি রয়েছে খুব কম ক্ষেত্রেই।” ইউবিআই ব্যাঙ্কের কৃষিঋণ বিভাগটি দেখেন পার্থ কর। তিনি জানালেন, যৌথ নামে জমি থাকলে, কিংবা স্বামীর বয়স বেশি হয়ে গিয়ে থাকলে তবেই স্ত্রীয়ের নাম ঋণপত্রে আসে। এবং জানা গেল, ‘স্বল্পমেয়াদি কৃষিঋণ’-এর মাত্র ১৫ শতাংশের মতো আছে মেয়েদের নামে।
দুই ‘কৃষকরত্নের’ দিকে তাকালেও সমস্যার আন্দাজ পাওয়া যায়। ফুলমণির নিজের নামে কোনও জমিই নেই। স্বামী-শ্বশুরের জমি চাষ করেন তিনি। আর চাষের কাজ নিজের মতো করে করবেন বলে বিয়েই করেননি ছন্দারানি। “মায়ের সঙ্গে ফাইট করতে হয়েছে। কিন্তু পরাধীনতা খুব কষ্টের ব্যাপার।” মা, ভাই আর নিজের জমি মিলিয়ে প্রায় ছয় একর জমি চাষ করেন ছন্দা।
ছবি: দেবরাজ ঘোষ
অর্থনীতিবিদ নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “তেভাগা থেকে নন্দীগ্রাম, যে জমি বাঁচাতে মেয়েরা প্রাণ দিয়েছে, সে জমিতে তাদের কোনও অধিকার নেই।” চাষের জমি, চাষের শ্রম, কোনওটার জন্যই মেয়েদের স্বীকৃতি মেলে না। না পরিবার থেকে, না সরকারের থেকে। নির্মলাদেবীর কথায়, “মেয়েদের শ্রম আসলে তার পরিবারের সম্পদ। তা যাতে পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাই মেয়েদের নির্ভরশীল করে রাখা হয়। রাষ্ট্রও পরিবারকেই সমাজের মৌলিক একক বলে ধরে। ফলে পরিবারের ভিতরে মেয়েটির সম্পদহীনতা কারও চোখে পড়ে না।” আক্ষেপের কথা, ভারতে নারী আন্দোলনও এ বিষয়টি এড়িয়েই গিয়েছে। গত দুই দশকে নারীনির্যাতন নিয়ে যত কথা হয়েছে, মেয়েদের জমি, জল, জঙ্গলের অধিকার নিয়ে তার সিকিভাগও হয়নি।
এখন অবশ্য রাষ্ট্র তার নিজের তাগিদেই সেই নকশা খানিকটা বদলাচ্ছে। ব্লক কৃষি আধিকারিক নবকুমারবাবু জানালেন, এক বছর আগেও তাঁদের ব্লকে কিষান ক্রেডিট কার্ডের কেবল দুই শতাংশ ছিল মেয়েদের নামে। এখন কৃষি দফতরের উদ্যোগে তা হয়েছে ১০ শতাংশ। মোট ৮৭০০ কার্ড দেওয়া হয়েছে মেয়েদের। কেন এই উদ্যোগ? “কোলাঘাটে পুরুষরা সব গেঞ্জি-জাঙ্গিয়ার কারখানায় কাজ করতে চলে যাচ্ছে। মেয়েরা না এগিয়ে এলে চাষ করবে কে?” এমনকী ওড়িশা থেকে যে মজুররা ধান কাটতে আসছেন, তাদেরও অর্ধেক এখন মেয়ে, বললেন তিনি। এটা অবশ্য কেবল এই ব্লকের ছবি নয়। ১৯৯১ সালে মুক্ত অর্থনীতি শুরু হওয়ার পর থেকে গোটা ভারতেই কৃষিতে পুরুষ কমছে, বেড়ে চলেছে মেয়েদের সংখ্যা।
কৃষিতে বৈচিত্র আনার যে কথা বলছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা, তাতেও মেয়েরাই উত্‌সাহ দেখাচ্ছে বেশি। “গোপালনগর হাট, দেহাতি, গুড়চাকি, কাটাবনি-শাসনে এখন প্রচুর সব্জি, ফুলের খেত। মেয়েরাই তো চাষ করছে,” বললেন নবকুমারবাবু। বাপের বাড়ি থেকে বিবাহিত মেয়েদের চাষের জমির ভাগ দিতে প্রবল আপত্তি থাকলেও (“মেয়েরা জেনেশুনেই জমি লিখে দেয় ভাইদের,” বললেন ছন্দারানি) শ্বশুরবাড়িতে বউদের নামে কিষান ক্রেডিট করানোর ঝোঁক বাড়ছে। যত কার্ড, তত ঋণ আসবে ঘরে।
আর মেয়েগুলোও বদলে যাচ্ছে বইকী। ঝাড়গ্রাম থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরের কুসমাশুলি গ্রামের মেয়ে ফুলমণি পুরস্কারের ১০ হাজার টাকা পেয়ে নিজের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে জমা দিয়েছেন। এক পয়সাও তুলতে দেননি কাউকে, আবার চাষের কাজেই টাকাটা লাগাবেন। “স্বামীকে বলেছি, আমার নামে জমি দিতে হবে।” ইন্দ্রজিত্‌ও কিছুটা জমি লিখে দিতে রাজি। কাগজের প্রতিবেদককে একান্তে তাঁর প্রশ্ন, “তার পর আমাকে বউ পাত্তা দেবে তো?”

তথ্য সহায়তা: কিংশুক গুপ্ত, আনন্দ মণ্ডল


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.