ঠুং ঠাং টিকরবেতা গ্রামে ঢুকলেই চারপাশ থেকে শুধু এই আওয়াজ। বোলপুরের ছোটশিমুলিয়া, খয়রাশোলের পাথরকুচি, হজরতপুর, লাউবেড়িয়া, লোকপুর, দুবরাজপুরের কিছু গ্রামেও দিনভর ধাতব সিম্ফনি।
প্রশাসনের হিসেবে, বীরভূমের দু’শোরও বেশি পরিবার কাঁসা-পিতলের থালা-বাটি ও কলসি তৈরির কাজে যুক্ত। কিন্তু সে সব জিনিয়ের চাহিদা কমছে। মূলত বিয়েবাড়ি, পুজোপার্বণ বা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানেই সীমিত হয়ে পড়েছে কাঁসার ব্যবহার। আর কাঁসা-পিতলের ঢালাই ও মিনে করা শৌখিন জিনিস বানাতে হলে চাই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও বিশাল অঙ্কের টাকা, যা এই গ্রামীণ শিল্পীদের নেই। বড় ব্যবসায়ী বা মহাজনেরা কাঁচা মালের জোগান দেন। পরে শিল্পীদের তৈরি করা কলসি, থালা, বাটি তাঁরাই কেজি প্রতি ১১০-১৫০ পর্যন্ত মজুরির বিনিময়ে নিয়ে নেন।
প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কী ভাবে বাজারের চাহিদা বদলের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যায়, মূলত সেই ভাবনা থেকে ২০০৮ সালে টিকরবেতায় তৈরি হয়েছিল বীরভূম ব্রাস অ্যাণ্ড বেল মেটাল ক্লাস্টার ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি। শুধু ওই গ্রামের ১১১টি পরিবার নয়, জেলায় যে সব পরিবার এই শিল্পে যুক্ত তাদের এক ছাতার তলায় নিয়ে আসাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। মোট ১৮৫ জন কারিগর ওই সমবায়ে যুক্ত হয়েছেন। |
টিকরবেতার এক ব্যস্তা কাঁসাশিল্পী।—নিজস্ব চিত্র। |
সমবায়ের সদস্য তথা প্রাক্তন সম্পাদক নবদ্বীপ কর্মকার জানান, একটি নিজস্ব ‘কমন ফেসিলিটেড সেন্টার’ (সিএফসি) গড়ার পরিকল্পা রয়েছে তাঁদের। সেখানে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রিরও বন্দোবস্ত হবে। জেলা শিল্প দফতরের ব্যবস্থাপনায় ২০ জনের একটি দল ভিন্ রাজ্য থেকে এই শিল্পের অন্য শাখার প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে। জেলা পরিষদের টাকায় একটি জায়গাও কেনা হয়েছে। খোলা হয়েছে একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট।
কিন্তু এর পরে আর এগোয়নি। সমবায়ের বাড়িই তৈরি হয়নি এখনও। সরকারের ভূমিকা নিয়েও কারিগরেরা সন্দিহান। বর্তমান সম্পাদক প্রবীর সালুইয়ের অভিযোগ, “কার্ড থাকা সত্বেও ক্ষুদ্র বা মাঝারি ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কগুলি সহযোগিতা করছে না।” জেলা সভাধিপতি তথা স্থানীয় বাসিন্দা অন্নপূর্ণা মুখোপাধ্যায় বলেন, “মৃতপ্রায় শিল্পটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সমবায় ভবনের জন্যও টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু তখনও জায়গা কেনা না হওয়ায় সেটা কাজে লাগানো যায়নি।” তাঁর অভিযোগ, “পরে যখন জায়গা মিলল, রাজনৈতিক পালাবদল হয়ে গিয়েছে। বহুবার সংশ্লিষ্ট বিভাগে অনুরোধ জানানো হলেও ফল হয়নি। এই সরকার আগের সরকারের প্রকল্প নিয়ে উৎসাহী নয়, তাই এই অবস্থা।”
এখন ঠিক কী অবস্থা, জেলা শিল্পকেন্দ্রের জেনারেল ম্যনেজার আশুতোষ সেন তা নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি। তবে মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, “বোলপুরের লেদার কমপ্লেক্স, রাজনগরের তসর এবং টিকরবেতার কাঁসা-পিতলের শিল্প বাঁচাতে কেন্দ্রের কাছে অর্থ সাহায্যের অনুমোদন চাওয়া হয়েছিল। শুধু মাত্র লেদার কমপ্লেক্সের জন্যই সাহায্য মিলেছে।” তাঁর আশ্বাস, “বাকি দু’টি ক্ষেত্রেও আমরা আন্তরিক চেষ্টা করছি। আগের সরকার উদ্যোগী হয়েছিল বলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, এমন নয়।”
টিকরবেতার হারাধন মেহতরি, চতুরা সালুই, পাথরকুচির বোধন কবিরাজ, হজরতপুরের বিশ্বনাথ হালদারেরা বলেন, “ভীষণ পরিশ্রমের কাজ। তাই বাড়ির মহিলাদের সাহায্য নেওয়ার উপায় নেই। এর উপরে শ্রমিক পাওয়ার সমস্যা এবং চাহিদার পরিবর্তনে বংশ পরম্পরায় চলে আসা এই শিল্পে আগ্রহ হারাচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। তবে প্রযুক্তির সাহায্য পেলে মহিলারা কাজে যোগ দিতে পারবেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মও উৎসাহী হবে।” |