না আছে লোক, না আছে ক্ষমতা। আক্ষরিক অর্থেই নিধিরাম সর্দার হয়ে বসে রয়েছে ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলিকে দমনের দায়িত্ব পাওয়া সরকারি সংস্থাগুলি!
পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা দেশ জুড়ে ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নিকারী সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইছে কেন্দ্র। এ বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রী সচিন পায়লট। অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের কাছেও এই সংস্থাগুলির উপর নজরদারি বাড়ানোর জন্য আবেদন জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু এই সংস্থাগুলিকে দমনের দায়িত্ব যাদের, তারাই ধুঁকছে লোকবলের অভাবে! আর এই সব সংস্থার কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যাদের, সেই শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি-র হাতে নেই যথেষ্ট ক্ষমতা!
পশ্চিমবঙ্গে আজ যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা রুখতে ‘সেবি’ হাত মেলাচ্ছে এসএফআইও (সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস)-র সঙ্গে। কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রকের অধীনস্থ এই ‘এসএফআইও’ সংস্থাটিই মূলত অর্থ লগ্নিকারী সংস্থাগুলির বেআইনি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তদন্ত করে। কিন্তু লোকের অভাবে একেবারেই বেহাল দশা তাদের। সংস্থার তদন্তকারী বাহিনীতে শতকরা ৪০ ভাগ পদই খালি! আইনি বিভাগে ৯০ শতাংশ পদ শূন্য, অন্যান্য বিভাগেও ৭৯ শতাংশ খালি। যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির বক্তব্য, দশ বছর আগে এই সংস্থাটি তৈরি হলেও তার কাজকর্মের দিকে কোনও গুরুত্বই দেয়নি কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক।
একই অবস্থা কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রকের অধীন কোম্পানি নিবন্ধক বিভাগেও। অর্থলগ্নি সংস্থাগুলিকে এই কোম্পানি নিবন্ধকই প্রয়োজনীয় অনুমোদন দিয়ে থাকে। সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট বলছে, কাজের চাপে দিশেহারা অবস্থা কোম্পানি নিবন্ধকের। ২০১২ সালে দু’লক্ষ সংস্থার আবেদন জমা পড়েছে। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসেব অনুযায়ী, ভুয়ো নথিপত্র জমা দেওয়ার অভিযোগে তদন্তের জন্য প্রায় ৫০ হাজার মামলা পড়ে রয়েছে। নতুন কোম্পানি আইন কার্যকর হলে এই কাজের চাপ বাড়বে বই কমবে না। এ জন্য নতুন তথ্যপ্রযুক্তি পরিকাঠামোর সঙ্গে দক্ষ কর্মী সংখ্যাও বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন কমিটির চেয়ারম্যান যশবন্ত সিন্হা।
কেন এত লোকবলের অভাব? সরকারি সূত্রের বক্তব্য, দুই বিভাগে দু’রকম সমস্যা। এসএফআইও-র কাজকর্ম চলছে অন্য বিভাগ থেকে সরকারি কর্মী-অফিসার ধার নিয়ে অথবা স্বল্পসময়ের চুক্তিতে কর্মী নিয়োগ করে। কিন্তু লোভনীয় সুযোগ-সুবিধা না থাকায় কেউই এসএফআইও-তে আসতে চাইছেন না। উল্টো দিকে কোম্পানি নিবন্ধকের কর্তারা স্বল্প সময়ের চুক্তিতে কর্মী নিয়োগ করতে নারাজ।
ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির কাজকারবার নিয়ন্ত্রণে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল সেবি-র ভূমিকা। এদের লোকবলের অভাব না থাকলেও যথেষ্ট ক্ষমতার অভাব রয়েছে। কারণ সব ধরনের আর্থিক জালিয়াতি রোখার মতো যথেষ্ট আইনি ক্ষমতা সেবি-র নেই। এ বিষয়ে নতুন আইন তৈরির জন্য মনমোহন সিংহের সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনও তার অনুমোদন মেলেনি। সেবি-র কর্তাদের বক্তব্য, খুব কম সময়ে প্রচুর আয়ের লোভ দেখিয়ে মানুষকে ঠকানোর নতুন নতুন উপায় বাজারে আসছে হামেশাই। বাড়ি, মরুভূমির মধ্যে জমি, এমু পাখি, ভেড়া-ছাগল, আলুর বন্ড, এমনকী অ্যান্টিক দেখিয়েও ব্যবসা করছে এই সংস্থাগুলি। অর্থলগ্নি সংস্থাগুলিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা সেবি-র নির্দেশিকা মেনে কাজ করতে হয়। কিন্তু এই সংস্থাগুলি এমন ভাবে কাজ করছে, যাতে তা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা সেবি, কোনও নির্দেশিকার আওতাতেই আসে না। তাই কারও পক্ষেই ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেই জন্যই নতুন আইন তৈরির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে অর্থ মন্ত্রকে।
সেবি-র প্রস্তাব, যে কোনও চুক্তিতেই লগ্নিকারীদের থেকে টাকা তুলে ১০০ কোটির তহবিল গড়া হলে তা সেবি আইনের আওতায় আসবে। অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি কী উপায়ে টাকা তুললে তাকে ‘চিট ফান্ড’ হিসেবে ধরা হবে, তা-ও নির্দিষ্ট করতে চাইছে সেবি।
বাড়তি ক্ষমতা না পাওয়া পর্যন্ত সেবি তাই ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলি দমনে রাজ্য পুলিশের পাশাপাশি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট, বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা (আইআরডিএ)-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে চাইছে। একই সঙ্গে লগ্নিকারীদের সতর্ক করার জন্য প্রচার বাড়াতে চাইছে কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক। পায়লটের নির্দেশ, এসএমএস, দূরদর্শনের মাধ্যমে প্রচার চালানো হোক। পেশাদার সংস্থাগুলির সঙ্গে হাত মেলানোর পাশাপাশি ডাকঘরের পাসবুকেও বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। পায়লট জানান, এই ধরনের সংস্থাগুলির বেআইনি কাজকারবার বন্ধ করার জন্য যে আইন রয়েছে, তার নিয়মাবলীও অর্থ মন্ত্রকের তরফে রাজ্যগুলিকে পাঠানো হয়েছে। |