ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার নিয়ন্ত্রণে রাজ্যের হাতে এখন কোনও আইন নেই। অথচ রাজ্যের লক্ষ লক্ষ আমানতকারী এ সব সংস্থায় টাকা রেখে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তাঁদের ক্ষোভ চাপা দিতে ও দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে রাজ্য সরকার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিল। প্রাক্তন বিচারপতি শ্যামল সেন কমিশনের মাথায় বসবেন। তাঁকে সাহায্য করবেন বিবিধ ক্ষেত্রের আরও চার-পাঁচ জন বিশেষজ্ঞ।
পাশাপাশি, সরকার অতি দ্রুত অভিযুক্ত সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করতে স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম বা বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মহাকরণে মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “কমিশনের প্রধান হওয়ার জন্য প্রাক্তন রাজস্ব সচিব সুনীল মিত্রকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় রাজ্য সরকারের প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেননি তিনি।” |
ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থা নিয়ে বৈঠকে সপার্ষদ মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার মহাকরণে নিজের ঘরে। ছবি: সুদীপ আচার্য |
সিট-এর নেতৃত্ব দেবেন রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। তদন্তকারী দলে কারা থাকবেন, তিনিই তা বাছাই করবেন। ঠিক হয়েছে, সিআইডি, এসটিএফ, বিধাননগর ও কলকাতা পুলিশ থেকে শুরু করে রাজ্য পুলিশের বিবিধ শাখার অফিসারদের তদন্তকারী দলে রাখা হবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গুজরাত দাঙ্গার পরেও এমনই একটি তদন্তকারী দল গঠন করা হয়েছিল। রাজ্য সরকার সূত্রের বক্তব্য, ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির আর্থিক তছরুপের ঘটনাকেও রাজ্য সরকার এতটাই গুরুত্ব দিচ্ছে যে সে ক্ষেত্রেও সিট গঠন করা হচ্ছে। এর থেকে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট, ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে সরকার কঠোর মনোভাব নিতে কসুর করবে না। সরকারের এক মুখপাত্রের কথায়, “এ দিন মুখ্যমন্ত্রী অভিযুক্তদের যে কোনও মূল্যে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছেন।”
সরকার যে নতুন কমিশন গঠন করছে, তার কার্যবিধিও এ দিন ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাতে বলা হয়েছে, কোন সংস্থা কত দিন আগে তৈরি হয়ে, কী ভাবে মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলেছে, তা কমিশনকে তদন্ত রিপোর্টে জানাতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কমিশনের কাছে সবাই অভিযোগ জানাতে পারবেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে কমিশন প্রয়োজনে কোন সংস্থা, কোথায়, কত টাকা রেখেছে, তা খতিয়ে দেখবে। প্রয়োজনে সেই সংক্রান্ত কাগজপত্রও বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। এমনকী, কমিশন চাইলে সিট সমেত সব তদন্তকারী সংস্থাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিতে পারবে।”
বিরোধী বামেরা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর এই কমিশন গড়ার সিদ্ধান্তে খুশি নয়। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের যুক্তি, “তদন্ত কমিশন-আইন অনুযায়ী একটা কমিশন গড়ার ঘোষণা হয়েছে। সর্বস্বান্তদের ব্যাপারে তারা কী ব্যবস্থা করবেন? এটা বিচারবিভাগীয় তদন্ত নয়। আর্থিক সংস্থাগুলির ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু বিভাগের ভূমিকা আছে। কিন্তু রাজ্যের এমন কোনও এক্তিয়ারই নেই, যাতে এই কমিশনের বিচার্য বিষয়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারি বিভাগগুলি থাকতে পারে।” সূর্যবাবুর মন্তব্য, “আসলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছেন! যাতে মূল অপরাধীদের আড়াল করা যায়। এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছি না।”
বছর দেড়েক ধরে এমন একাধিক ভুঁইফোঁড় সংস্থার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়েছে রাজ্যের ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে। রাজ্যের ক্রেতা সুরক্ষামন্ত্রী সাধন পাণ্ডে জানিয়েছেন, অভিযোগ পেয়ে তাঁরা বিষয়টি রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে জানান। কিন্তু তাঁরা নিজেরা কেন ব্যবস্থা নেননি?
সাধনবাবুর ব্যাখ্যা, “আইন মোতাবেক আমাদের দফতরের কিছু করণীয় ছিল না। অভিযোগ যা জমা পড়ত, তা সবই মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হতো।” এখন পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠায় চিন্তিত সাধনবাবুও। তিনি চান কড়া হাতে দমন করা হোক ওই ধরনের সংস্থাগুলিকে।
তাই তাঁর বক্তব্য, রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকেও এই নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। তিনি বলেন, “আজ, মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠক আছে। মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই এই বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেবেন।”
এখনও পর্যন্ত সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই আমানতকারীদের টাকা না মিটিয়ে ঝাঁপ বন্ধ করার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু রাজ্যের এখনও ছোট-বড় মিলিয়ে কয়েকশো টাকা তোলার সংস্থা গরিব মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে। তিন-চারটি বড় সংস্থার টাকা ফেরত দেওয়ার সময়সীমা হচ্ছে এ বছরের শেষ থেকে সামনের বছরের শেষ পর্যন্ত। সরকারি সূত্রের খবর, টাকা ফেরত না পেয়ে আমানতকারীদের যে বিক্ষোভ সারদা গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে চলছে, তা অচিরেই অন্য সংস্থাগুলিকে ঘিরেও শুরু হবে। তা হলে সেন কমিশন কি শুধুমাত্র সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগই তদন্ত করবে? মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কমিশন এ সংক্রান্ত যে কোনও অভিযোগেরই তদন্ত করবে। যদি অন্য সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, কমিশন তা-ও দেখবে।”
মুখ্যমন্ত্রী এ-ও জানান, প্রাক্তন বিচারপতি সেনকে সাহায্য করার জন্য চার-পাঁচ জন বিশেষজ্ঞকে দেওয়া হবে। তার মধ্যে এক জন চার্টার্ড অ্যাকাউট্যান্ট, অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার, এক জন অর্থনীতিবিদ, কর্পোরেট জগতের কোনও প্রতিনিধি এবং কোনও ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞকেও রাখা হতে পারে। তবে সরকারি অফিসারদের কথায়, “কমিশনের প্রধানই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। তিনিই সংশ্লিষ্ট পক্ষকে শুনানিতে ডেকে সমস্ত অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেন। প্রয়োজনে নথিপত্র খতিয়ে দেখেন। এবং সরকারকে সুপারিশ জানাবেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞেরা ঠিক কী ভাবে কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করবেন, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।”
অফিসারেরা আরও একটি বিষয়ে ধন্দে রয়েছেন। তাঁদের মতে, “তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে রাজ্যে গত দেড় বছরে ১১টা কমিশন তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে পাঁচটি কমিশন কাজ করছে। শুধুমাত্র স্থানাভাবে বাকি ছ’টি কমিশন শুরুই করা যায়নি!” মহাকরণ সূত্রের খবর, ইন্দিরা ভবনে চারটি কমিশনকে বসানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। বাকি দু’টো কমিশন কোথায় কাজ শুরু করবে, তা এখনও ঠিক হয়নি। এর মধ্যেই ফের একটি কমিশন তৈরি হল। কিন্তু সেই কমিশন কোথায় এবং কবে থেকে কাজ শুরু করবে, তা নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেট সূত্রের খবর, সোমবার রাত পর্যন্ত সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের হদিশ মেলেনি। তাঁর খোঁজে বিধাননগর কমিশনারেটের তিনটি দল দেশের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি শুরু করেছে। সারদা গোষ্ঠীর অধীনে ন’টি সংস্থা রয়েছে। তার মধ্যে চারটি সংস্থার কর্মীরা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা দায়ের করেছেন। প্রতারণার অন্য মামলাটি করেছেন সারদা গোষ্ঠীর অধীন ভ্রমণ সংস্থার এক গ্রাহক। পুলিশ জানায়, সল্টলেকের দু’টি বাড়িতে সুদীপ্তবাবু থাকতেন। সেই বাড়ি দু’টির একটি ভাড়া নেওয়া, অন্য বাড়িটির মালিক সুদীপ্তবাবু। তাঁর পরিবারের কোনও সদস্যের খোঁজও বাড়ি দু’টিতে মেলেনি বলে দাবি করেছে পুলিশ।
সারদা গোষ্ঠীর অন্যতম ডিরেক্টর ধৃত মনোজকুমার নেগেলকে জেরা করে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, সংস্থায় আরও দশ জন ডিরেক্টর রয়েছেন। গোষ্ঠীতে তাঁদের কী ভূমিকা আর প্রভাবই বা কতটা, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
|
এক্তিয়ার কমিশন |
• কারা কবে থেকে কী ভাবে টাকা তুলেছে
• কারা কোথায় কত টাকা রেখেছে
• সেই সংক্রান্ত নথি বাজেয়াপ্ত করা
• প্রয়োজনে সিট-কে নির্দেশ সিট
• ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির আর্থিক তছরুপ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত |
|