অনর্থ রুখতে অস্ত্র-সন্ধান
অন্যান্য সংস্থা ঘিরেও জমছে আশঙ্কার মেঘ
ক্ষ লক্ষ আমানতকারী, এজেন্টদের পথে বসিয়ে পাততাড়ি গুটিয়েছে সারদা গোষ্ঠী। কিন্তু রাজ্যে এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নিকারী সংস্থা। যদিও সারদা-কাণ্ডের জেরে সরকার নড়েচড়ে বসার পরে তাদের অনেকেই টাকা লোপাট করে ব্যবসা গোটাতে পারে বলে প্রশাসনের একটা বড় অংশের আশঙ্কা। সে ক্ষেত্রে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বেন আরও কয়েক লক্ষ মানুষ। কারণ প্রচারের আলোয় না-থাকলেও গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা এই সব সংস্থায় চমকপ্রদ লাভের আশায় টাকা রেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই। কর্মী এবং এজেন্টের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এই লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বার্থরক্ষাই আপাতত রাজ্য সরকারের প্রধান মাথাব্যথা।
আমানতকারীদের টাকা ঘুরপথে অন্যত্র সরিয়ে ফেলে এই সব সংস্থার কর্ণধারেরা যাতে উধাও হয়ে যেতে না-পারেন, সে জন্য অবিলম্বে কড়া আইন তৈরি করতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সংক্রান্ত বিলের একটি খসড়া ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে সেই বিল সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। আজ সেই খসড়ায় ছাড়পত্রের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেছেন মমতা। তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী অসুস্থ খবর পেয়ে তাঁর শারীরিক অবস্থা জানার জন্য ফোন করেছিলেন প্রণববাবু। তখনই তাঁকে ওই অনুরোধ জানান মমতা।

প্রতিবাদ অব্যাহত। রবিবার কলকাতা বিমানবন্দরের
আড়াই নম্বর গেটের সামনে। —নিজস্ব চিত্র
ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নিকারী সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে যাতে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে জন্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গেও কথা বলবেন মুখ্যমন্ত্রী। চিদম্বরম আজ রাতে দেশে ফিরবেন। তার পরেই দু’জনের কথা হবে।
মমতা চাইছেন, সন্দেহভাজন সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে নিজের থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার দেওয়া হোক রাজ্যকে। বর্তমান আইনে কোনও আমানতকারী প্রতিশ্রুত অর্থ না-পাওয়ার অভিযোগ দায়ের করার আগে রাজ্য সরকারের কিছু করার নেই। রাজ্য নিজের থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার পেলে আর্থিক অনিয়ম লাগামছাড়া হওয়ার আগেই তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে প্রশাসনিক কর্তাদের আশা। এর পাশাপাশি, যে সব সংস্থা আমানতকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিলাম করার অধিকারও চাইছে রাজ্য সরকার। যাতে নিলামে ওঠা টাকা থেকে আমানতকারীদের পাওনা যথাসম্ভব মিটিয়ে দেওয়া যায়।
কেন্দ্রীয় সরকারের সূত্রে বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রস্তাব গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করা হচ্ছে। রাজ্যকে কতটা অধিকার দেওয়া যায় তা খতিয়ে দেখছেন অর্থ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা। এ ব্যাপারে কেন্দ্রের সামনে উদাহরণ হিসেবে রয়েছে সহারা সংস্থার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ। ওই সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করে সেই অর্থ আমানতকারীদের ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। পাশাপাশি, অর্থলগ্নিকারী সংস্থাগুলির অনিয়ম খতিয়ে দেখতে অর্থ মন্ত্রক, সেবি এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটি প্রতিনিধি দল খুব শীঘ্রই পশ্চিমবঙ্গে যাবে। রাজ্যের মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠক করবেন তাঁরা। আগামিকাল মহাকরণে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে একটি তদন্ত কমিশন গড়তে পারেন মুখ্যমন্ত্রীও।
সারদা গোষ্ঠীর মতো আরও যে সব ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থা রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাওয়া হলে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় আজ বলেন, “সংশ্লিষ্ট দফতরকে সব কিছু খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। কারা আইন মেনে ব্যবসা করছে, কারা করছে না, সেটা অবিলম্বে জানাতে বলা হয়েছে।”
কিন্তু সুদীপ্ত সেন পালানোর পরে সরকারের বুদ্ধি বাড়ল কেন, সেই প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে। আর এ নিয়ে শাসক তৃণমূলের সঙ্গে বিরোধী সিপিএমের চাপানউতোর শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, “চিট ফান্ডের দৌরাত্ম্য ১৯৮০ সাল থেকে চলছে। তখন সিপিএম বা কেন্দ্র ব্যবস্থা নেয়নি কেন? মাত্র দেড় বছরের তৃণমূল শাসনে তো চিট ফান্ডের এত রমরমা হতে পারে না!” তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, সারদা গোষ্ঠী-সহ এই ধরনের বহু সংস্থাকে বাম আমলেই ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল।
সেই অভিযোগ খারিজ করে বাম আমলের অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত বলেন, “রাজ্য সরকার এই ধরনের সংস্থাকে অনুমোদন দিতেই পারে না। যাঁরা এ কথা বলছেন, হয় তাঁরা জানেন না। না হয় জেনেও মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন।” অসীমবাবুর ব্যাখ্যা: অর্থলগ্নিকারী সংস্থা সাধারণত দু’ধরনের হয়। এক ধরনের সংস্থা চলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ১৯৮৯ সালের নির্দেশিকা অনুযায়ী, যারা মানুষের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে অনেক বেশি সুদসমেত তা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দেয়। দ্বিতীয় ধরনের সংস্থা চলে সেবি-র ১৯৯৯ সালের নির্দেশিকা অনুসারে, যারা জনতার কাছ থেকে নেওয়া টাকার বিনিময়ে জমি বা ফ্ল্যাটের আশ্বাস দেয়। না-দিতে পারলে বহু গুণ বেশি টাকা মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলে ব্যবসা করে। এই দু’ধরনের সংস্থাই অনুমোদন পায় কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্প মন্ত্রকের অধীন কোম্পানি নিবন্ধকের কাছ থেকে।
সওয়াল-জবাব
অসীমের প্রশ্ন
• বাম সরকার যে চারটি সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে, তার মধ্যে সম্প্রতি বন্ধ হওয়া সংস্থাটিও ছিল। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে আর তদন্ত চালাল না কেন?
• বাম আমলে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো বিলে অনুমোদনের জন্য এই সরকার কী করেছে?
• বন্ধ হয়ে যাওয়া সংস্থাটির কর্ণধারকে গ্রেফতার করতে বিলম্ব হচ্ছে কেন?
• সরকার জানান, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কী করেছেন?
• অন্য সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?
মুকুলের উত্তর
• এর উত্তর সরকার দেবে। তবে যেটুকু জানি, রাজ্য নতুন নির্ভুল আইন তৈরি করবে।
• ওই বিলটাই তো ত্রুটিযুক্ত! সে জন্যই তো ওটা কেন্দ্রকে ফেরত পাঠাতে বলা হয়েছে।
• পুলিশ চেষ্টা করছে। দাউদ ইব্রাহিমকে কি ভারত সরকার গ্রেফতার করতে পেরেছে?
• ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে সরকার আছে। এই সংক্রান্ত আইনটি কেন্দ্রের। তাদের সঙ্গে কথা বলে অর্ডিন্যান্স জারি করে কিছু করার চেষ্টা চলছে।
• সেটা সরকার বলবে। তবে নতুন নির্ভুল আইন তৈরি হলে অনেক কিছু করা যাবে।
বর্তমান রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অসীমবাবুর পাল্টা অভিযোগ, টাকা নয়ছয় হতে পারে এই আগাম আশঙ্কার ভিত্তিতে তাঁদের আমলে, ২০১০ সালে সারদা গোষ্ঠী-সহ চারটি সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছিল। বিষয়টি লিখিত ভাবে জানানো হয়েছিল সেবি-কে। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে সেই তদন্ত আর চালানো হয়নি।
বাম আমলে কেন্দ্রের কাছে পাঠানো বিলে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়ার ব্যাপারে তৃণমূল সরকার কী করেছে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন অসীমবাবু। তিনি বলেন, “বিলটি যাতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়, তার জন্য ২২ মাসের রাজ্য সরকার কী করেছে? শুনছি নতুন একটা আইন করতে চাইছেন। আগে পাঠানো বিলেই তো গ্রেফতার, যাবজ্জীবন শাস্তির ব্যবস্থা ছিল? এর চেয়ে শক্তিশালী আইন আর কী হবে?”
সারদার ব্যাপারে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর অভিযোগের জবাব এড়িয়ে গেলেও বিল সম্পর্কে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের বক্তব্য, “ওই বিলটাই তো ত্রুটিপূর্ণ। সেই জন্যই তো ওটা কেন্দ্রকে ফেরত পাঠাতে বলা হয়েছে।” বাম আমলে ভুইঁফোড় আর্থিক সংস্থার রমরমা হলেও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি কেন, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। অসীমবাবু যদিও দাবি করেছেন, ১৯৮০-৮১, ১৯৯০-৯১ এবং ২০০২-০৩ সালে যখনই প্রতারণার লিখিত অভিযোগ রাজ্য সরকার পেয়েছে, তদন্ত চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে।
নতুন আইন তৈরির ব্যাপারে চাপানউতোর থাকলেও বর্তমান আইন যে ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নিকারী সংস্থাগুলির রাশ টানার কাজে যথেষ্ট নয়, সে ব্যাপারে শাসক-বিরোধী দু’পক্ষই এক মত। তৃণমূল নেতাদের মতো অসীমবাবুরও বক্তব্য, এখন রাজ্য সরকার যদি কারও কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পায় যে তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন, তা হলেই ভারতীয় দণ্ডবিধি এবং ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ীই অভিযুক্ত সংস্থার কর্ণধারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। পাশাপাশি ওই সংস্থার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা নিলামে তুলে আমানতকারীদের পাওনা মেটানোর জন্য আদালতে আবেদন করা যায়। বামফ্রন্ট সরকার ১৯৯৪-৯৫ সালে এই ভাবেই হাইকোর্টে আবেদন করে সম্পত্তি নিলামের পক্ষে রায় পেয়েছিল।
কিন্তু এতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে দেখে ২০০৩ সালে রাজ্যের নিজস্ব আইন করার জন্য বিধানসভায় বিল পাশ করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন অসীমবাবু। রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য দীর্ঘ দিন সেই বিল দিল্লিতে পড়েছিল। পরে কেন্দ্র বিল ফেরত পাঠিয়ে দু’টি পরামর্শ দেয় এবং সেই দু’টিই মেনে নিয়ে ২০০৯ সালে ফের বিলটি (ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রোটেকশন অফ ডিপজিটর্স ইন্টারেস্ট ইন ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন্স বিল) পাশ করানো হয়। কিন্তু সেই বিলেও রাষ্ট্রপতির সম্মতি মেলেনি। বাম জমানায় অর্থমন্ত্রী এবং রাজ্যের অর্থসচিব মিলে অন্তত ১২ বার দিল্লিতে দরবার করার পরেও কেন রাষ্ট্রপতি সই করছেন না সেই ব্যাখ্যা দেয়নি কেন্দ্র, দাবি অসীমবাবুর।
অসীমবাবুর মতো কেন্দ্রকে কাঠগড়ায় তুলেছেন মুকুলবাবুও। তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পর থেকে সব চেয়ে বেশি সময় কেন্দ্রের সরকার চালিয়েছে কংগ্রেস। আইন কাদের হাতে? কংগ্রেস কী করছিল?” এর জবাবে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য দিগ্বিজয় সিংহ আবার বলেন, “রাজ্যের স্থানীয় গোয়েন্দা ব্যবস্থার মাধ্যমে সংস্থাগুলি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে কেন্দ্রকে রিপোর্ট দেওয়া হয়। বাম বা তৃণমূল কোনও আমলেই এটা ঠিক ভাবে হয়নি।” অসীমবাবু অবশ্য দাবি করেছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে তাঁরা অনুরোধ করেছিলেন কোনও সংস্থাকে নথিভুক্ত করার আগে রাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে যেন রিপোর্ট চাওয়া হয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি।
কেন্দ্রীয় সরকার স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার এবং এজেন্টদের কমিশন কমিয়ে দেওয়ার ফলেই ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নিকারী সংস্থাগুলির রমরমা হয়েছে বলে বাম এবং তৃণমূল দুই শিবিরের দাবি। রাজনীতির এই টানাপোড়েনের মধ্যেই রক্তচাপ বাড়ছে অজস্র ভুইঁফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার লক্ষ লক্ষ এজেন্ট-আমানতকারীর। রুজিরোজগার থেকে সারা জীবনের সঞ্চয় খোয়ানোর আতঙ্কে ভুগছেন তাঁরা। মাঝপথেই টাকা তুলে নিতে হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন সংস্থাগুলির দফতরে। কিন্তু ইতিমধ্যেই টাকা দেওয়া বন্ধ করেছে অনেক সংস্থা। ফলে কার্যত আরও বড় বিপর্যয়ের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে রাজ্য। সেই বিপর্যয় ঠেকানোই এখন চ্যালেঞ্জ শাসক দলের।

পুরনো খবর:
পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.