চোখে পড়ে সবুজ গালিচার মতো ধান খেত, আর কানে আসে তাঁত বোনার শব্দ। দু’বছর ধরে এমনই দেখছি বর্ধমানের পূর্বস্থলী ১ পঞ্চায়েত সমিতির শ্রীরামপুরকে। পাশেই ভাগীরথী, ঐতিহ্যের শহর নবদ্বীপ। আর রয়েছে এক বিশাল জলাশয়।
বড়কোবলা বাঁধশাল বিলের ধার ঘেঁষে রয়েছে চাষজমি। ফলে ভূগর্ভস্থ জল না তুলেই বিলের জলে অনায়াসে চাষবাস করা যায়। আর বর্ষায় ফরাক্কা বাঁধ থেকে জল ছাড়ার ফলে এর জল আরও বাড়ে। অনেক বাসিন্দা এই বিলকে পুজো করেন, নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে জল সাফও করেন। আর এখন তো একশো দিনের প্রকল্পে স্থানীয় পঞ্চায়েত বিল রক্ষণাবেক্ষনের ব্যয়ভার বহন করে।
তবু এলাকার ছোট চাষিদের কাছে সেচের জল দুর্লভ। কারণ সেচের কাজে ব্যবহার হয় ডিজেল পাম্প। পাম্প কিনতে যেহেতু বেশ বড় অঙ্কের টাকা দিতে হয়, তাই ছোট বা মাঝারি চাষিদের ধারে পাম্প নিতে হয় বড় চাষিদের থেকে। ২০১২ সালে পাম্প ভাড়া ছিল প্রতি ঘণ্টায় ১৫০ টাকা। গরমে এবং শীতে এক বিঘা ধান চাষ করতে মোটামুটি তিন বার তিন ঘণ্টা করে টানা জল দিতে হয়। ফলে জলের যোগান দিতেই খরচ হয়ে যায় প্রায় ১৩৫০ টাকা। এর সঙ্গে আরও বাকি খরচাগুলো ধরলে লাভের অঙ্কে অনেকটাই ঘাটতি হয়ে যায়। পাম্পের সঙ্গে সঙ্গে বীজ, সার বা কীটনাশকও ধারে দেন বড় চাষিরা ছোট চাষিদের। |
ধার শোধ করার মূলত তিনটে পথ রয়েছে:
১। টাকা: শস্য ঘরে তোলার আগে খুব কম পরিবারই টাকা দিয়ে ধার শোধ করতে পারে।
২। শ্রম: এটাই সবথেকে প্রচলিত পথ।
৩। শস্য বিক্রি: এটাও প্রচলিত, তবে সাধারণত চাষিরা প্রায় ফেলে দেওয়ার দামেই শস্য বিক্রি করেন।
সব মিলিয়ে চাষির হাতে প্রায় কিছুই থাকে না। উৎপাদনের সব খরচের মধ্যে জলের খরচই বেশি। যেহেতু ব্যাঙ্ক বা সমবায়ের থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ ছোট চাষিদের খুবই কম, তাই জলের জন্য পাম্প মালিকদের উপরেই নির্ভর করতে হয়। জল নেওয়া থেকে ঋণ শুরু হয় আর তারপর বীজ, সার, কীটনাশক ক্রমাগত চড়া সুদে ঋণ নেওয়া চলতেই থাকে। চাষের শুরু থেকে ফসল তোলা, পুরো বৃত্তটার শেষে চাষিরা যা হাতে পান তা শুধুমাত্র তাঁদের শ্রমের দাম।
কিন্তু ছোট, প্রান্তিক চাষিরা চুপ করে থাকেন কেন?
প্রথমত, এলাকার রাজনীতিতে এই পাম্প মালিকদের বেশ প্রতিপত্তি থাকে। বড় চাষির পরিবারের কোনও একজনের পঞ্চায়েতে সরাসরি প্রতিনিধিত্ব এবং বাকিদের কোনও না কোনও ভাবে রাজনীতির সঙ্গে যোগ থাকে। ফলে এঁদের বিরুদ্ধে কথা বলার জোর পাওয়াটাই মুশকিল। উপরন্তু, যদি বা কেউ এর বিরুদ্ধে কথা বলেন তাহলে তাঁকে এলাকার কেউ পাম্প ধার দেবে না, বা সুদে ছাড় মিলবে না, এ ধরণের হুমকি দেওয়া হতে থাকে।
দ্বিতীয়ত, এলাকার চালকল মালিক, হিমঘর মালিকদের সঙ্গেও এঁদের একটা সম্পর্ক থাকে। এই সম্পর্কের আবার অনেকগুলি স্তর থাকে। শ্রীরামপুরে স্থানীয় ডিজেল পাম্প মালিকদের পারস্পরিক যোগাযোগ রয়েছে, যেটা সবচেয়ে নীচের স্তর। এর উপরে রয়েছে একাধিক মধ্যস্বত্ত্বভোগী যাঁরা হিমঘরে পয়সা ঢালেন। তাঁদেরও অন্য স্তরগুলির সঙ্গে নানা যোগ রয়েছে। প্রত্যেকটা স্তরে কোনও রাজনৈতিক দল বা বিশেষ কোনও ব্যক্তির প্রভাব রয়েছে। এই পুরো ধাঁচাটার লক্ষ্যই হল গোটা এলাকার কৃষিকাজের উপর দখল নেওয়া, ফসল বোনা থেকে তা হিমঘরে মজুত করা কিংবা চালকলে পাঠানো পর্যন্ত।
শেষে বলতে হয়, পশ্চিমবঙ্গে এখনও সেচের জল নিয়ন্ত্রণের কোনও সুসংহত পরিকল্পনা নেই। সরকার, বেসরকারি সংগঠন, এমনকী আন্তজার্তিক সংস্থাগুলিও জল বণ্টনের ব্যবস্থার বিকেন্দ্রিকরণের কথা বলছে। জল যাঁরা ব্যবহার করবেন, সেই চাষিরাই সংগঠন তৈরি করে জলের উৎস, আহরণ এবং বণ্টন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন, এমনই মনে করা হয়। কিন্তু সেচ দফতর তার জন্য যে ব্যবস্থা নিচ্ছে, তার গতি অত্যন্ত শ্লথ। পশ্চিমবঙ্গ যদিও ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় প্রশাসনিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রিকরণের জন্য ভারতে সুবিদিত, কিন্তু সেচের ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রিকরণ সামান্য, বিচ্ছিন্ন। নিয়ন্ত্রণের কোনও নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান না থাকায় জলের দখল নিয়ে এলাকার কৃষিজাত পণ্যের উপর আধিপত্য বজায় রাখা সহজ এবং স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। |